ভুলে যাওয়া বাঙালি রান্নাঃ নিম শুক্তো

“রন্ধনশালাতে যাই তুয়া বঁধু গুণ গাই/ ধূয়ার ছলনা করি কাঁদি”।।

বাংলার প্রাচীন কবির এই পদটি আজকের রাধা আর বলতে পারবে না। কেননা, আজ আর সেই কাঠের জ্বালের দমবন্ধ করা রান্নাঘর নেই। খুব বেশি আগের কথা নয়, রান্নাঘরে রান্না হত কয়লার উনুনে। তার ধোঁয়া তো থাকতই, সঙ্গে বাসনে  পড়ত কালি। উনুন রোজ পরিষ্কার করতে হত। রান্না হয়ে গেলে উনুনের নিভু নিভু আঁচেও বসানো থাকত এমন কিছু পদ যা ওই কয়লার উনুনের সঙ্গেই উধাও হয়ে গিয়েছে। উনুন ঠান্ডা হয়ে গেলে পরিষ্কার করতে হত। রান্না শেষ হয়ে গেলে রান্নাঘর ভাল করে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে রাখা হত।

সকালে রান্নাঘরে ঢোকার আগে গৃহিণীদের স্নান করে আসতে হত। এসব আজ রূপকথার মতো শোনালেও শহর থেকে দূরের পল্লীগ্রামের অন্তঃপুরে আজও এই রীতি বজায় আছে।

“আজি গণেশের মাতা রান্ধ মোর মত/  নিমে সিমে বেগুনে রান্ধিয়া দিবে তিত।।” কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের “ চন্ডীমঙ্গল” কাব্যের “ নিমে সিমে বেগুনে”-র যে তিতো পদটি আজও বাঙালির খাদ্যতালিকায় সমাদৃত সেটি হল শুক্তো। আমাদের এই গ্রীষ্মপ্রধান দেশে শরীর ঠাণ্ডা রাখার জন্য শুক্তোর জুড়ি নেই। বাংলার একেবারে নিজের এই পদটি ভাতের সঙ্গে সবার প্রথমে খাওয়া হয়। “ তিতো দিয়ে খাওয়া শুরু, অম্বলেতে শেষ।/ বাঙালির যত রান্না স্বাদেতে অশেষ”।। এক শুক্তোরই কত রকমফের।  বাংলার পূর্ব থেকে পশ্চিমে পাড়ি দিতে গিয়ে কত যে রূপ বদলালো সে। সেই রকম এক শুক্তোর রেসিপি রইল আজ।

নিমপাতার শুক্তো

নিমগাছে যখন নতুন নিম পাতা দেখা যায় অর্থাৎ চৈত্রমাস নাগাদ তখন এই শুক্তো বেশি ভালো লাগলেও সারা বছর ধরেই এটি তৈরি করা যায়।

কী কী লাগে-

নিম পাতা (কচি পাতা হলে ২টো ডাল আর বড় পাতা হলে ১টি ডাল),  মাঝারি মাপের বেগুন(৩টে), সজনে ডাঁটা (৪-৫টা), রাঙা আলু( বড় হলে ২টো, ছোট হলে ৩টে), কাঁচকলা(২টো), শিম( ৫/ ৬টা)- চৈত্র মাসে শিম পাওয়া গেলেও দেখে কিনতে হবে তাতে পোকা না থাকে। গরম পড়ে গেলে শিম না দিয়ে পটল(৫/৬টা) দিতে হবে। মটর ডালের বড়ি অথবা করাই/ বিউলির ডালের বড়ি বড়ি দিতে হবে (১০টা)  

মশলা লাগবে-

ধনে গুঁড়ো (২ চা চামচ, সরষে বাটা (২চা চামচ), আদা বাটা(১ চা চামচ)

ফোড়নের জন্য লাগবে-

সরষে ও পাঁচফোড়ন, নুন ও চিনি (স্বাদমতো্‌ সরষে(২ চামচ) কাঠখোলায় অর্থাৎ কড়াই গরম করে সরষে ভেজে নিয়ে গুঁড়ো করে নিতে হবে। সরষে বেশি ভাজা হলে তেতো হয়ে যাবে। তাই সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

কী ভাবে রাঁধতে হবে-

প্রথমে সব তরকারিগুলো অন্ততপক্ষে পনেরো মিনিট জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপর নিমপাতাগুলো ভাল থেকে ছাড়িয়ে নিতে হবে। রাঙা আলুগুলো খোসা ছাড়িয়ে মাঝারি মাপের লম্বা করে কেটে নিতে হবে। রাঙা আলু বড় ও মোটা হলে লম্বা করে কেটে আবার মধ্যে দিয়ে কেটে নিতে হবে। সব্জি যেন খুব ছোট বা বড় করে কাটা না হয়। তাহলে রান্না জমবে না।

শিমের দু’পাশ থেকে সুতো ছাড়িয়ে অর্ধেক করে নিতে হবে। বেগুনের বোঁটা কেটে লম্বা করে কেটে আবার মধ্যে দিয়ে কেটে নিতে হবে। সজনে ডাঁটা লম্বায় বড় হলে  চার টুকরো, না হলে তিন টুকরো করতে হবে। কাঁচকলার খোসা ছাড়িয়ে লম্বা করে দু-ফালা করে মধ্যে দিয়ে আবার কেটে নিতে হবে। পটল খুব কচি হলে গা চেঁছে নিলে চলবে কিন্তু খোসা মোটা হয়ে গেলে খোসা ছাড়িয়ে দুফালি করতে হবে।

এবার কড়াই গ্যাসে বসিয়ে একটু গরম হলে সরষের তেল দিতে হবে। তেল গরম হলে বড়ি ভেজে রাখতে হবে। বড়ি খুব কড়া ভাজতে হবে না। আবার কাঁচাও যেন না থাকে। বেগুন হালকা করে ভেজে তুলে নিতে হবে। নিমপাতা ছাড়িয়ে হালকা ভেজে রাখতে হবে।

এই রান্নায় খুব বেশি তেল লাগে না। তেলে পাঁচফোড়ন ও সরষে ফোড়ন দিয়ে বেগুন, বড়ি আর নিমপাতা বাদে অন্য আনাজগুলো তেলে দিয়ে একটু ভেজে নিয়ে জল দিয়ে ফোটাতে হবে। এই সময় নুন, মিষ্টি ও ১টা কাঁচালঙ্কা দিতে হবে। শুক্তো যেন ঝাল না হয়। সেই অনেককালের ছড়াটা এই রান্নার সময় মনে রাখতে হবে। “ছি ছি ছি রাণী রাঁধতে শেখে নি/ শুক্তুনিতে ঝাল দিয়েছে, অম্বলেতে ঘি”।

আজকাল যদিও রাণীদের পাশাপাশি রাজাদেরও রাঁধতে হয়, শিখতে হয় নানান খুঁটি নাটি। তাই কোন রান্নায় কোনটা একেবারে লাগবে না সেটাও জানতে হবে। কড়াইতে তরকারিগুলো দিয়ে থালা চাপা দিয়ে গ্যাস একটু কমিয়ে দিতে হবে। তরকারিগুলো আধসিদ্ধ হলে বেগুন, ভাজা বড়ি ও আদাবাটা আর চিনি দিয়ে আবার ফোটাতে হবে। এবার ভাজা নিমপাতা দিয়ে একটু ফুটিয়েই নামিয়ে ভাজা সরষের গুঁড়ো ছড়িয়ে নামিয়ে নিলেই তৈরি নিম পাতার শুক্তো- নিমফুলের মধুর চেয়ে যার স্বাদ কম নয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...