ভুলে যাওয়া বাঙালি রান্নাঃ ডুমুরের কৌড়া

"পিরিতি যগডুমুরের ফুল, পিরিতি আলোকলতার মূল/ ভাব না জেনে ধরতে গেলে জীবের পক্ষে ভুল"- এই " যগডুমুর" বা যজ্ঞডুমুর বাংলার নিজস্ব ফল। বাংলার পথে প্রান্তরে এই গাছের দেখা মেলে। তবে ডুমুরের দেখা পাওয়া গেলেও ডুমুরের ফুল আদৌ সহজলভ্য নয়। তাই অনেকদিন কারো দেখা না পেলে তাকে " ডুমুরের ফুল" বলা হয়। নানা গুণে গুণী এই ফল শরীরে রক্তচাপ ঠিক রাখতে, ওজন ও সুগার ঠিক রাখতে, হার্টের সমস্যা ও অন্যান্য নানা রোগকে দূরে রাখতে সাহায্য করে।  রূপসী বাংলার  এই নিজস্ব সম্পদটির উল্লেখ আছে জীবনানন্দ দাশের কবিতাতেও-" অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে/ চেয়ে দেখি ছাতার মতো বড় পাতাটির নীচে/ বসে আছে ভোরের দোয়েল পাখি"। বাঙালির রন্ধনশৈলীতেও এই ডুমুরের নানা রূপ ধরা আছে। আজকের লেখায় ধরা রইল তারই কিছু বিবরণ।

FotoJet

ডুমুরের কৌড়া


ফেলে আসা দিনের রান্না কৌড়া। নারকেল আর সর্ষে বাটা দিয়ে নরম ধরণের এই রান্নাটি সাবেক পূর্ববঙ্গের নিজস্ব
উদ্ভাবন।


কী কী লাগবে


ডুমুর – ২৫০ গ্রাম
নারকেল- আধমালা

সর্ষে- ২৫ গ্রাম
কাঁচালঙ্কা- ৩/৪ টে
কালোজিরে- ফোড়নের জন্য
সর্ষের তেল- আন্দাজমতো
চিনি- স্বাদমতো
নুন- স্বাদমতো
 
কীভাবে রাঁধতে হবে

ডুমুর ধুয়ে নিয়ে খোসাগুলো একটু ছাড়িয়ে অর্ধেক করে কেটে ছুরি দিয়ে ভেতরের দানাগুলো বের করে নিয়ে হলুদ মেশানো জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে। কিছুক্ষণ পরে জল থেকে তুলে প্রেশারকুকারে একটা সিটি দিয়ে নিতে হবে। নারকেল কুড়িয়ে বেটে নিতে হবে।নিজের পছন্দ অনুযায়ী কালো অথবা সাদা সর্ষে কাঁচালঙ্কা ও নুন দিয়ে বেটে নিতে হবে। ডুমুরগুলো জল ঝরিয়ে নিতে হবে। কড়ায় সর্ষের তেল দিয়ে গরম করে কালোজিরে, কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে ডুমুরগুলো দিয়ে ভালোভাবে নাড়াচাড়া করতে হবে।নুন দিতে হবে। যদি ডুমুর ভালো সেদ্ধ না হয় তবে সামান্য জল দিয়ে গ্যাস কমিয়ে ঢাকা দিয়ে কিছুক্ষণ রাখতে হবে। ডুমুর সেদ্ধ হয়ে এলে সর্ষেবাটা, নারকেলবাটা, চিনি ও কাঁচালঙ্কা চিরে দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। জল শুকিয়ে এলে নামিয়ে রাখতে হবে। কৌড়া কিন্তু খেতে হবে গরম ভাতের সঙ্গে।

FotoJet (1)

ডুমুরের শুক্তো

 

সেই আদ্যিকাল থেকে যে সব পদ বাঙালি রসনাকে মুগ্ধ করে রেখেছে তার অন্যতম শুক্তো। মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর লেখাতেও ‘শুক্তা রন্ধন পরিপাটি’- র বিবরণ আছে। আজ এমনই একটি শুক্তোর রন্ধনপ্রণালী দেখে নেওয়া যাক। 
 
কী কী লাগবে


ডুমুর- ২৫০ গ্রাম

পেঁপে- ১৫০ গ্রাম
কাঁচকলা-৩টি
রাঙাআলু- ২০০ গ্রাম
সজনে ডাঁটা- ৫/৬ টা
করলা বা উচ্ছে-৫০ গ্রাম
মটর ডালের বড়ি- ৬/৭টা
সর্ষে-৩০ গ্রাম
পোস্ত- ৩০ গ্রাম
হলুদগুঁড়ো- সামান্য
পাঁচফোড়ন- ফোড়নের জন্য
রাঁধুনি- ফোড়নের জন্য
আদাবাটা- ১ বড় চামচ
ঘি- ২ বড় চামচ
সর্ষের তেল- রাঁধবার জন্য
কাঁচালঙ্কা- ২/৩ টি
চিনি- সামান্য
নুন- স্বাদমতো
 
কীভাবে রাঁধতে হবে

 

ডুমুর ভাল করে ধুয়ে গায়ের খোসা তুলে নিয়ে অর্ধেক করে কেটে ভেতরের দানাগুলো ফেলে দিতে হবে। এরপর হলুদ গোলা জলে ডুমুরগুলো ভিজিয়ে রাখতে হবে। পেঁপে, কাঁচকলা, সজনে ডাঁটা, করলা বা উচ্ছে ধুয়ে নিয়ে জলে অন্তত ১৫ মিনিট ভিজিয়ে রাখতে হবে। রাঙাআলু জলে ধুয়ে নিয়ে আলাদা করে ভেজাতে হবে।  সর্ষে-কালো অথবা সাদা যেটা পছন্দ সেটা নিয়ে ১ টা কাঁচালঙ্কা আর সামান্য নুন দিয়ে মিহি করে বেটে নিতে হবে। আদা এবং পোস্তও আলাদা আলাদা করে বেটে রাখতে হবে। জলে ভেজানো ডুমুরগুলো প্রেশারকুকারে একটা সিটি দিয়ে আধসেদ্ধ করতে হবে। পেঁপে ও রাঙাআলু ডুমো ডুমো করে কাটতে হবে। কাঁচকলার খোসা ছাড়িয়ে নিয়ে, বড় কাঁচকলা হলে তিন টুকরো করে হলুদ জলে ডুবিয়ে রাখতে হবে। করলা বা উচ্ছে যাই নেওয়া হোক না কেন পেঁপের তুলনায় ছোট ছোট করে কেটে নিতে হবে। সজনে ডাঁটা ২ ইঞ্চির চেয়ে একটু বড় মাপে কেটে নিতে হবে। কড়ায়  সর্ষের তেল দিয়ে গরম করে বড়িগুলো ভেজে নিতে হবে। ওই তেলেই উচ্ছে বা করলা অল্প ভেজে রাখতে হবে। কাঁচকলাও হালকা ভেজে নিতে হবে। এবার তেল যদি কমে আসে তবে একটু তেল দিয়ে গরম করে তাতে ১ চামচ ঘি মিশিয়ে শুকনোলঙ্কা,পাঁচফোড়ন ও রাঁধুনি ফোড়ন দিতে হবে। ফোড়নের গন্ধ বের হলে পেঁপে, রাঙাআলু ও সজনে ডাঁটা দিয়ে ভালভাবে নেড়ে জল ঢেলে সেদ্ধ করতে হবে। পেঁপে প্রায় সেদ্ধ হয়ে এলে উচ্ছে, ডুমুর, কাঁচকলা, বড়ি আর নুন ও সামান্য চিনি দিয়ে ফোটাতে হবে। জল কমে এলে অল্প জল দিয়ে সর্ষে বাটা, পোস্তবাটা, অর্ধেক আদাবাটা ও কাঁচালঙ্কা দিয়ে ফোটাতে হবে। ঘন হয়ে এলে বাকি আদাবাটা ও ঘি দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে নামিয়ে রাখতে হবে। শুক্তো যে গরম ভাত ছাড়া জমবে না সেকথা তো সবারই জানা।

FotoJet (6)
 
ডুমুরের চপ
 
কী কী লাগবে


ডুমুর- ২৫০ গ্রাম
চন্দ্রমুখী আলু- ৩০০ গ্রাম
পেঁয়াজ- ২টো বড়
আদাবাটা- ১ চা চামচ
লঙ্কাগুঁড়ো- স্বাদ অনুযায়ী
আমচুর- ১ চা চামচ
জিরে ভাজার গুঁড়ো- ১ চা চামচ
নারকেল কুচি- ২ বড় চামচ
গরমমশলা গুঁড়ো- ১ চা চামচ
কিশমিশ- ৫০ গ্রাম
ঘি- ১ চামচ
ডিম – ৪ টে
ময়দা- প্রয়োজনমতো

বিস্কুটের গুঁড়ো- প্রয়োজনমতো
 
কী করে রাঁধতে হবে

 

ডুমুর ধুয়ে গায়ের খোসা ছাড়িয়ে অর্ধেক করে ভেতর থেকে দানাগুলো বের করে ফেলে দিতে হবে। হলুদ গোলা জলে ডুমুর ভিজিয়ে রাখতে হবে। একটা পেঁয়াজ সরু সরু করে কাটতে হবে। অন্য পেঁয়াজটা মিহি করে বাটতে হবে। ডুমুরগুলো প্রেশারকুকারে সেদ্ধ করে নিতে হবে। আলুও সেদ্ধ করে নিতে হবে। সেদ্ধ আলুর খোসা ছাড়িয়ে ভাল করে চটকে নিতে হবে। চটকানো আলুতে নুন আর ময়দা দিয়ে মেখে রাখতে হবে। ময়দা দেওয়ায় আলুতে একটু আঁট ভাব আসবে। সেদ্ধ করে রাখা ডুমুরগুলোও চটকে নিতে হবে। নারকেল, মালা থেকে ছুরি দিয়ে তুলে কুচি করে রাখতে হবে।গ্যাসে কড়া চাপিয়ে সাদা তেল ও ঘি মিশিয়ে গরম করে পেঁয়াজ কুচি দিয়ে লাল করে ভেজে নিতে হবে। কড়ায় তেল কমে এলে আরও একটু তেল দিয়ে নারকেল কুচিগুলো ভেজে নিয়ে তুলে রেখে পেঁয়াজ বাটা, লঙ্কাগুঁড়ো, আদাবাটা, চিনি ও নুন দিয়ে ভালো করে কষতে হবে। জলের ছিটে দিয়ে কষিয়ে আবার একটু জল দিয়ে নাড়তে হবে। কিশমিশ ও নারকেল কুচি ভাজা মিশিয়ে কষাতে হবে।জিরে ভাজার গুঁড়ো আর গরমমশলাগুঁড়ো দিয়ে নেড়ে নামিয়ে ঠান্ডা করতে হবে। এটা হল চপের পুর। এই পুরটা ঠান্ডা হলে পেঁয়াজভাজা ছড়িয়ে মিশিয়ে নিতে হবে। আলুমাখাটা থেকে বেশ খানিকটা নিয়ে হাত দিয়ে বাটির মতো খোল করে তার ভেতরে ডুমুরের পুর ভরে মুখ বন্ধ করে চপের আকার দিতে হবে। ডিম ভালোভাবে ফেটিয়ে নিয়ে চপগুলো ফেটানো ডিমে ডুবিয়ে বিস্কুটের গুঁড়ো মাখাতে হবে। চপ থেকে আলগা গুঁড়ো ঝেরে ফেলে গরম তেলে বাদামি করে ভাজলেই তৈরি ডুমুরের চপ। অনেকে আছেন যারা ডিম, পেঁয়াজ খান না তারা পেঁয়াজ ছাড়া পুর বানাতে পারেন। ডিমের বদলে ময়দা গুলে তাতে চপ ডুবিয়ে বিস্কুটের গুঁড়ো মাখিয়ে ভেজে নিলেই তৈরি হবে সম্পূর্ণ নিরামিষ ডুমুরের চপ। কী জলখাবারে, কী ভাত অথবা পোলাও- র সঙ্গে সঙ্গতে এই চপের জুড়ি নেই।

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...