অরণ্যবাসীদের আরাধ্যা দেবী উত্তরবাহিনী

বাংলার ধর্ম দর্শনে মিশে রয়েছে লোকায়েত দর্শন। অজস্র লৌকিক দেব দেবী সমৃদ্ধ করেছেন পল্লী বাংলার ইতিহাস। গঙ্গাপাড়ের জেলা হুগলির তেমনই ঐতিহ্যবাহী সমৃদ্ধ ইতিহাসে আমরা উত্তরবাহিনী দেবীর কথা জানতে পারি। অতি প্রাচীন লৌকিক দেবী হলেন উত্তরবাহিনী। হুগলির শিয়াখালা বা শিবক্ষেত্রে দেবীর মন্দির অবস্থিত। মন্দিরটি বাংলার নিজস্ব স্থাপত্যরীতিতেই তৈরি। মন্দির চুড়াহীন, মেঝে শ্বেতপাথরের। মন্দিরের সামনেই রয়েছে বিশাল নাটমন্দির। রয়েছে ভোগঘর। দেবীর নিত্যপুজো হয়। অন্ন ভোগ দেওয়া হয় দেবীকে, এছাড়াও বিশেষ বিশেষ তিথিতে বলি দান চলে। নিত্যদিনের পুজোয় ফল মিষ্টি ইত্যাদি দেওয়া হয়। ব্রাহ্মণেরাই এই মন্দিরের পুজোর দায়িত্বে থাকেন। তাঁদের মতে উত্তরবাহিনী দেবী ও বিশালাক্ষী দেবী এক এবং অদ্বিতীয়। উত্তরবাহিনী দেবীর পুজোয় বিশলাক্ষি দেবীর ধ্যান মন্ত্রে পুজো করা হয়। কিন্তু দেবীর পুজোয় দেবীকে উত্তরবাহিনী বলেই সম্বোধন করা হয়।

দেবী মূর্তি সুশ্রী, বলিষ্ঠ, দীর্ঘকায়, উচ্চতায় প্রায় ছয় ফুট। ত্রিনেত্রের অধিকারীনি দেবী দ্বিভুজা, ডান হাতে খড়গ এবং বাম হাতে রুধির পাত্র নিয়ে বিরাজমান তিনি।একদা দেবীর সঙ্গে মরার খুলিও রাখা হত। এলোকেশী দেবীর গাত্রবর্ণ রক্তাভ হরিদ্রা, মাথায় মুকুট পরিহিতা দেবী নানা অলঙ্কারে ভূষিতা হন। মাথায় থাকে মুকুট, নাকে নথ, গলায় নানান হার ও মুন্ডমালা থাকে।

হিন্দুস্থানী মেয়েরা যে ধরনের হার, চুড়ি পরেন, সেই একই ধরণের অলংকার পরেন দেবী। বক্ষবন্ধনী ও বিচিত্র রঙের গাড়াজাতীয় শাড়িতে সেজে ওঠেন মা। উত্তর বাহিনীর বাম পা থাকে নীল বর্ণের বটুক ভৈরবের মাথায় আর অন্য পা থাকে শায়িত মহাকাল শিবের বুকে, মহাকাল শিবের নাভিদেশে একটি বৃহদাকারের অসুরের মুন্ড ও গলার কাছে দুটি সাপের মূর্তি দেখা যায়। আদপে শায়িত শিবের দেশে পা তুলে দেওয়ার মাধ্যমে দেবীর প্রাধান্য প্রকাশ করা হয়। কিছুকাল আগেও দেবী মূর্তি ছিল মাটির। এখন পাথরের মূর্তিতে পূজিতা হন দেবী।  দেবীর দুটি আদি মূর্তি রয়েছে, দুটিই ক্ষুদ্রাকৃতি তাই নতুন মূর্তি নির্মিত হয়েছে। যা ভোগমূর্তি পরিচিত। বাংলার আর কোন লৌকিক দেবতার বা দেবীর এতো বড় মূর্তি দেখা যায় না।

উত্তরবাহিনী দেবীর পুজোর কথা মধ্যযুগীয় মঙ্গলকাব্যে ছড়িয়ে রয়েছে।

রূপরামের ধর্মমঙ্গলে রয়েছে,

"শ্মশানে বন্দিলাম শ্যামা করালবদনী।

সেই খালায় বন্দিলাম উত্তর বাহিনী।"

ষোড়শ শতকেও গহন অরণ্যে আবৃত ছিল হুগলি জেলা।

ঐ অংশের অধিবাসীরা ছিল অনুন্নত। তারা ছিল দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। রাজশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেও পিছপা হয়নি তারা। তদানীন্তন বাংলার অধিপতি ছিলেন সুলতান হোসেন শাহ। যার উজির ছিলেন পুরন্দর খা। সুলতানী সৈন্যের সেনানায়ক রূপে পুরন্দর খা আদিবাসীদের দমন করেন। অনেকেই বলেন, পুরন্দর খা আদপে গোপীনাথ বসু, যিনি শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল রচনা করেছিলেন। আদিবাসীদের দমন করার পুরস্কারস্বরূপ হোসন শা-এর কাছ থেকে হুগলির শিয়ালখালা অঞ্চলের জায়গির পান পুরন্দর। তারপর শিয়াখালাতেই তিনি মন্দির ও প্রাসাদ নির্মাণ করেন।

যদিও এ মন্দির নিয়ে আরও এক কিংবদন্তি রয়েছে। শিয়াখালা অঞ্চলের ভৌমিক বা জমিদার ছিলেন বিত্তবান। অর্থের মোহে তিনি রীতিমতো অন্ধ ছিলেন। সাধারণ মানুষদের মানুষ বলেই গণ্য করতেন না। একবার এক ব্রাহ্মণ সাহায্যের জন্য তার কাছে গেলে, তিনি ওই ব্রাহ্মণকে অপমান করে তাড়িয়ে দেন। ব্রাহ্মণ অপমানে আত্মহত্যা করতে কৌশিকী নদীর তীরে যান। হঠাৎ করেই নদীর জলে নিমজ্জিত থাকা একটি প্রস্তর মূর্তিতে চোখ পড়ে তার। আদপে সেটিই ছিল দেবী মূর্তি। তার মনে হয় সেই দেবী মূর্তি যেন তাকে আহ্বান করছে। ওই ব্রাহ্মণ সঙ্গে সঙ্গে মূর্তিটিকে তুলে নিয়ে এসে একটি পর্নকুটিরে প্রতিষ্ঠা করলেন। নিয়মিত ভাবে দেবী পুজো শুরু করলেন। পরে কোনও এক সময় ওই নদী দিয়ে ভৌমিক একটি নৌকা করে যাচ্ছিলেন, তার নৌকায় নাচ গান চলছিল। শোনা যায়, নাচ গান দেখে, দেবীরও তা উপভোগ করার ইচ্ছে হয়। তিনি মানুষের বেশ ধরে জমিদারকে নৌকা থামাতে বলেন। অর্থ গরিমায় অন্ধ জমিদার দেবীকে সাধারণ চাষীর মেয়ে মনে করে, নৌকা থামাননি। দেবী রাগে উত্তর দিকে মুখ ঘুরালেন, দেবীর কোপে ভৌমিকের নৌকা জলে তলিয়ে গেল। প্রচলিত বিশ্বাসে সেই উত্তরাস্যা দেবীই হয়ে উত্তরবাহিনী দেবী। আজও তার মন্দির দাঁড়িয়ে রয়েছে। মন্দিরের কাছেই একটি খাত দেখিয়ে স্থানীয়রা বলেন, ঐখানেই দেবী কোপে ভৌমিকের নৌকাডুবি হয়েছিল। তাঁদের মতে দেবী রুষ্ট হয়ে উত্তরাস্যা হয়েছিলেন বলেই তার নাম হয় উত্তরবাহিনী। তিনিই নাকি বিশালাক্ষী। তবে ঐ অঞ্চলে আরও অনেক উত্তরাস্যা দেবী আছেন কিন্তু কাউকেই বিশালাক্ষীর মর্যাদা দেওয়া হয় না।

তবে একথা সত্য যে হুগলির ঐ অঞ্চল এককালে জঙ্গলাবৃত ছিল।

অধিবাসীরা ছিল অনুন্নত শ্রেণির, তারা ছিল শক্তির উপাসক। উত্তরবাহিনী তাদেরই উপাস্যদেবী। পরে সভ্যতার ঠেলায় বন্য জাতি অন্যত্র চলে যায়। কিন্তু তাদের দেবী রয়ে গিয়েছেন সভ্যতায়।  কালক্রমে সুশ্রী আকৃতি পেয়েছেন। লৌকিক দেবী থেকে শাস্ত্রীয় দেবীর মর্যাদা পেয়েছেন। দেবীর মন্দির হয়েছে। হুগলির উত্তরবাহিনী মন্দিরে আজও মহাসমারোহে পুজো হয়। দূর-দূরান্ত থেকে ভক্ত সমাগম হয়। দুর্গাপুজোর বিসর্জনের পরে শুক্ল একাদশী তিথিতে মা উত্তর বাহিনীর বিশেষ পুজো হয়। নবঘট প্রতিষ্ঠা হয়। আজও উত্তর বাহিনী পুজো উপলক্ষ্যে এই সময় বিরাট মেলা বসে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...