অনলাইন ‘বুক’ শপিং অ্যাপ ঠিক কী বস্তু, তখনও কেউ জানেন না, এ দেশে অন্তত কারোর মাথাতেও আসেনি এই আইডিয়া। ইন্টারনেটই এসে পৌঁছায় নি তখন। প্রায় ৩২ বছর আগের কথা। তিনি তখন যুবক। হঠাৎ-ই তাঁর মাথায় আসে বই ‘ডেলিভারি’ করার অভিনব আইডিয়া। তখন থেকেই ‘দুর্লভ’, ‘বাজারে পাওয়া দুষ্কর’-এধরনের বইয়ের যোগান দিয়ে চলেছেন কলকাতার তরুণ কুমার সাউ।
৩২ বছর ধরে বাড়িতে বাড়িতে বই ডেলিভারি করছেন গ্রন্থপ্রেমী এই ব্যক্তি। কলকাতার কোনো বইপ্রেমী তাঁর কাঙ্ক্ষিত বইটি খুঁজে না পেলে, তাঁর শেষ আশ্রয় ‘তরুণ দা’। ১০০ বছরের মধ্যে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে প্রকাশিত যে কোনো বই দায়িত্ব নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিতেন তিনি। সেই ধারা এখনও প্রবাহমান।
বিদেশী জর্নাল থেকে সংবাদপত্র কিংবা বিরল কোনো ম্যাগাজিন, সমস্তই পৌঁছে যাবে আপনার ঠিকানায়, শুধু তরুণ দা’র নম্বরটি একবার ডায়াল করতে হবে।
এই বিশেষ দক্ষতার জন্য ঋতুপর্ণ ঘোষ, অনিরূদ্ধ রায়চৌধুরী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো শহরের বিশিষ্ট পন্ডিতবর্গের ‘কাছের লোক’ ছিলেন তিনি। চাইলেই তাঁরা তরুণ’কে দিয়ে আনিয়ে নিতেন তাঁদের পছন্দ মতো বই। শুধু তাই নয়, বেশীরভাগ মিডিয়া হাউসই বইয়ের জন্য তাঁর স্মরণাপন্ন হন। ক্যালকাটা ক্লাব, টালিগঞ্জ ক্লাবের সদস্যদের পছন্দসই বইয়ের চাহিদা মেটাতে তরুণেরই ডাক পড়ে।
বাবা গোপাল লাল সাউ, কলকাতার নিউমার্কেটে 'দে অ্যান্ড ব্রাদার্স' নামক একটি বইয়ের দোকান চালাতেন। বাবার এই জীবনযাপনে কিঞ্চিত পরিবর্তন এনে, দোকানের বদলে বাড়ি-বাড়ি হোম ডেলিভারি দেওয়া শুরু করেন তরুণ, সঙ্গী একটি স্কুটার।
বর্তমানে পিডিএফ, কিন্ডেল এসে পড়ায় অনেক পাঠকই হার্ড কপি ছেড়ে সফ্ট কপির দিকে ঝুঁকছেন, এতে তাঁর মতো ব্যবসায়ীদের খানিক ক্ষতি হলেও, ব্যবসায় ভাটা পড়েনি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলছেন, “শুধু মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্য থাকলে বইয়ের দোকান খুলে ফেলতে পারতাম, সে ক্ষেত্রে ক্রেতারা শুধু পয়সার বিনিময়ে বই কিনে নিয়ে যেতেন, কিন্তু আমার উদ্দেশ্যটা আরও বড় ছিল। এত বছর কাজ করার পর আমরা খদ্দেরদের বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারি, কিন্তু আমাদের পর এ ব্যাপারে তাঁদের আর কেউ সাহায্য করতে পারবেন না, কারণ পাঠকদের বইয়ের স্বাদ সম্পর্কে তাঁদের বিশেষ ধারণাই নেই।“
প্রায়ই খদ্দেরদের থেকে এমন অনেক বই অর্ডার আসে যেগুলি এ দেশে পাওয়া যায় না, সে ক্ষেত্রে?
সেখানেও মুশকিল আসান হবে এই তরুণের নম্বর ডায়াল করেই। ইউরোপ ও আমেরিকার প্রকাশনী সংস্থাগুলির সঙ্গে ভালো যোগাযোগ থাকায়, খুব সহজেই বইগুলি হাতে পেয়ে যান তরুণ, এবং ক্রমেই তা পৌঁছে যায় শহরের ভিন্ন প্রান্তের বইপ্রেমী মানুষের ঘরে ঘরে। তবে দেশের বাইরের যে কোনো বইয়ের ক্ষেত্রে ২০০-৫০০ টাকা পর্যন্ত চার্জ নেন তিনি, যা নামমাত্র। অন্যথায়, ভারতে প্রকাশিত বইগুলির ক্ষেত্রে প্রিন্টেড প্রাইজের দামেই ক্রেতাদের বইগুলি বিক্রি করেন তিনি।
"স্নাতকোত্তর পর্ব শেষ করার পর কোনো চাকরি বা পারিবারিক ব্যবসার সঙ্গে আমি জড়াইনি। পারিবারিক সূত্রে আমাদের বইয়ের ব্যবসা ছিল, তাই বইয়ের সঙ্গে আমার শৈশব কেটেছে, সুতরাং এটাই আমাকে বইয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছিল," বলছেন ৫৫ বছরের তরুণ।
যদিও এ বিষয়ে ছোটো ভাইয়ের বিশেষ সাহায্য পান তরুণ। তা ছাড়াও আরো তিনজন ব্যক্তি সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি অপারেট করার ক্ষেত্রে তাঁকে সাহায্য করেন। এই তিন জন সাধারণত জার্নাল, ম্যাগাজিন ও সংবাদপত্র পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বে থাকেন। বইয়ের অর্ডার এলে, সে ক্ষেত্রে তরুণ বাবু ও তাঁর ভাই নিজেরাই ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেন সেই মূল্যবান বইগুলি। পাঠকেরা যাতে তাঁদের প্রয়োজনে সঠিক বইটি হাতে পান, সে বিষয়ে সবসময়ই অবগত তরুণ। একটা সময় ছিল যখন মাঝরাতেও বই পৌঁছে দিতে বেড়িয়ে পড়তেন তিনি। কিন্তু যাই হয়ে যাক, কখনই কাউকে ফিরিয়ে দেন নি। ‘না’ শব্দটি তাঁর অভিধানে ছিল না, এখনও নেই।