উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল খাওয়া-দাওয়া। আর বড়দিনেও তার ব্যাতিক্রম হয় না। বড়দিন এমন একটা সময়ে হয়, যখন শীত থাকে মধ্যগগনে। বাগান যেমন নানান ফুলে রঙিন হয়ে ওঠে, ঠিক তেমন বাজারও নানা সবজিতে ভরে ওঠে। ফুলকপি, বাধাকপি থেকে শুরু করে বিট, গাজর, পিয়াজ কলির রঙে রেঙে ওঠে সব, অসাধারণ দেখতে লাগে বাজারটা। শেষরাতে শহর ভিজে যায় শিশিরে, সব সতেজ হয়ে ওঠে।
কমলালেবু, নতুন গুড়ের আনাগোনা শুরু হয় বাড়িতে বাড়িতে। নলেন গুড়ে মিশে লজ্জায় যেন লাল হয়ে ওঠে রসগোল্লা আর সন্দেশ। গুড়ের পায়েস, জানুয়ারি পড়তেই পিঠে পুলির গন্ধ আহা! আহারের বাহারের আমরা সব মশগুল।
কেক না খেলে বড়দিনের ষোলোকলা পূর্ণ হয় না। ফ্রুট কেক, প্লাম কেক, রিচ ফ্রুট কেক, ওয়ালনাট কেক, কলকাতার বুকে এ'কদিন জমিয়ে কেকের ব্যাটিং। এককালে বাঙালির বড়দিনের প্রিয় কেক ছিল বড়ুয়ার কেক। সাধারণ বেকারির সাদামাটা ফ্রুট কেক এই সময় জটায়ুর ভাষায় হট কচুরিজের মতো বিকোয়।
পার্কস্ট্রিটের ফ্লুরিস, নিউমার্কেটের নুহাম তো আছেই, সেই সঙ্গে অনেক নতুন নতুন দোকানে এ শহরে দাপিয়ে কেকের রাজত্ব স্থাপন করেছে।
বড়দিনের কেক সাদামাটা হওয়ার একটি যুক্তিযুক্ত কারণ রয়েছে, আসলে বড়দিনের আগে সাহেবদের একধরণের উপবাস চলত, মদ, মাংস তারা ছুঁতেন না সে সময়। তারপরে এই উৎসবের মদ, মাংস, ডিম, ফলটল সব একবারের দিয়ে বেক করে নিতো। যা কালে কালে ক্রিসমাস কেকের আকার নিয়েছে। এখন তো আমরা কত রকম কেক খাই।
ক্রিসমাস মানেই রসনাতৃপ্তির এক আলাদা অনুভূতি, বড়দিনের খাবারে জায়গা করে নেয় ডাক ভিন্দালু, পিজ পোলাও, ইয়েলো রাইস, কোপ্তা মালাইকারি, চিকেন বা টার্কি রোস্ট, সল্ট মিট, রোজ-কুকিজ ও কুলকুলসের মতো আরও নানা পছন্দের পদ। ক্রিসমাসের কেকের বিভিন্ন স্বাদের সঙ্গে এইসব পদও আলাদা করে তৃপ্তি দেয় বড়দিনে।
সেকালের কলকাতায় একটা জিনিস দেখা যেত বড়দিনে। ইংরেজরা তাকে বলত ‘ডলি’। কলকাতার সাহেবরাই বড়দিনের কলকাতায় এক নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করল। যা আর অন্য কোথাও দেখা যায় না, ডলি উপহার দেওয়ার প্রচলন হল এ শহরে। খুব সম্ভবত ডালি মানে আমরা পুজোতে ঈশ্বরের জন্যে যে অর্ঘ্য নিবেদন করি, তার থেকেই ডলি কথাটার জন্ম, এই ডলিই কেক প্রেস্ট্রিকে জনপ্রিয় করল আমাদের খাস কলকাতায়। ডলি বড়দিনের উপহার বা ভেট। এই ডলির মধ্যে থাকত কেক, পেস্ট্রি, মাছ, মাংস, ফল ইত্যাদি এবং সাহেবরা এই উপহার সামগ্রী তাদের কর্মচারী, ভৃত্যদের উপহার হিসেবেই পাঠাতেন।
আবার ফ্যানি পার্কস-এর লেখা থেকে জানা যায় সাহেববাড়ির বেয়ারা, খানসামা ও অন্য কাজের লোকেরা বড়দিনে তাঁদের ইংরেজ মনিবদের ‘ডলি’ বা ভেট পাঠাতেন। তাতে থাকত ফলমূল, কেক থেকে শুরু করে মাছ-মাংস ইত্যাদি। এ ছাড়াও, বড়দিনে ইংরেজদের প্রতি আনুগত্য দেখাতে ‘ডলি’ পাঠাতেন ইংরেজদের সঙ্গে কাজের সূত্রে যুক্ত কেরানি, বেনিয়া, মুৎসুদ্দি ও দালালরা।
কবি ঈশ্বর গুপ্তর লেখা ‘বড়দিন’ কবিতায় ডলি-র কথা এসেছে-
"খ্রীষ্টের জনম দিন, বড়দিন নাম
বহুসুখে পরিপূর্ণ, কলিকাতা ধাম
কেরানী দেওয়ান আদি বড় বড় মেট
সাহেবের ঘরে ঘরে পাঠাতেছে ভেট
ভেটকী কমলা আদি, মিছরি বাদাম
ভালো দেখে কিনে লয়, দিয়ে ভাল দাম।"
রাধাপ্রসাদ গুপ্তর লেখা থেকে জানা যায়, 'খ্রিস্টমাস ডিনার বা সারা বছরের সবচেয়ে বড় ভোজের একটা বিশেষ চরিত্র ছিল। কলকাতাতেও এই ভোজে খাবারের মধ্যে একটা প্রধান জিনিস ছিল ‘বোর্স হেড’ বা শুয়োরের মাথা যা রোজমেরি, বে-লিফ (তেজপাতা), আপেল আর অন্যান্য উপকরণ দিয়ে সাজিয়েগুজিয়ে পরিবেশন করা হত। অপরিহার্য টার্কি ছাড়া ডাক রোস্ট, যত রাজ্যের জিনিস দিয়ে তৈরি বিরাট খ্রিসমাস পাই, প্লাম পুডিং, ট্যাঞ্জারিন লেবু, খেজুর, বাদাম, কিসমিস, চকোলেট ইত্যাদি।' পুরনো কলকাতায় বড়দিনে বাড়িতে বাড়িতে ভোজসভা আয়োজনের রেওয়াজ ছিল।
সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ ভোজ হত বড়লাটের বাড়িতে। কলকাতার এবং সুবে বাংলার নানান জায়গার রাজকর্মচারী ও সেনা কর্তারা এতে নিমন্ত্রিত থাকতেন।
ভারতের গভর্নর জেনারেলদের মধ্যে লর্ড কর্নওয়ালিশের জীবনযাত্রা ছিল সবচেয়ে আড়ম্বরহীন। তাঁর সাদামাটা জীবনযাত্রার জন্য তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন, কিন্তু ক্রিসমাস উপলক্ষ্যে তিনিও রাজসিক নৈশ ভোজের আয়োজন করতেন।
ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লিড কিউরেটর মিস মার্গারেট ম্যাকেপিস-এর রিপোর্টে বর্ণনা পাওয়া গিয়েছে যে, ভদ্রলোকরা রেড ওয়াইন পান করে গড়াগড়ি যেতেন। সেই রিপোর্টে আরও অনেক এমন রাজকীয় ভোজসভার বিবরণ পাওয়া যায়। এছাড়াও আরও এক সেরা নৈশ ভোজের কথা জানা যায়, যা ইতিপূর্বের সব রকম নৈশভোজের আয়োজনকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। সেটি ছিল ১৯৩৮ সালের বাংলার গভর্নর লর্ড ব্রেবোর্ন আয়োজিত ক্রিসমাস ‘বল’ পার্টি। রাজা-মহারাজা ও ১৪০ জন মান্যগণ্য অতিথির নামে কার্ড পাঠানো হয়েছিল, রাতভর চলেছিল খানা-পিনা এবং তখনকার দিনে ৫,২৯৬ টাকা খরচ হয়েছিল! এলাহি আয়োজন যাকে বলে। তবে আজ আর এমন ভোজসভা হয়না।
বড়দিনের পানীয়ের কথা বলতে গেলে হোম মেড ওয়াইনের কথা বলতে হয়। যার আঁতুরঘর হল বো ব্যারাকস। জিঞ্জার ওয়াইন, এছাড়াও গ্রেপস ওয়াইন, রেসিন ওয়াইন, পটেটো ওয়াইন বিভিন্ন রকম বেরি থেকে তৈরি ওয়াইন! সারা বছর বোতলের ওয়াইন পাওয়া গেলেও এই ওয়াইনের জনপ্রিয়তা এই সময়ে কিন্তু গগনচূম্বী। এই পাড়ার বাসিন্দারাই এই মদ বাড়িতে তৈরি করেন এবং ক্রিসমাস ইভ ও তার কয়েকদিন আগে থেকেই পসরা সাজিয়ে বসে বিক্রি করতে শুরু করেন।
সেই সঙ্গে কেক প্রেস্ট্রি তো আছেই, সেগুলিও হোম মেড। সারা শহর এবং রাজ্য থেকে মানুষ আসেন এই সব জিনিস কিনতে। রাস্তার দু-ধারে বাড়ির সামনে, বা বারান্দায় টেবিল নিয়ে বসে চলে বিকিকিনির আসর। পার্কস্ট্রিটেও এমন আসর বসে। তবে তা অন্য নানান খারাবের। করোনার কাঁটা এসবে আঘাত করেছে দু-বছর ধরে। তবু বাড়িতে খাওয়া তো চলতেই পারে, উৎসব সবার। মন খুলে, প্রাণ খুলে, রোগ ভুলে হামলে পড়ুন।