কবিপত্নী মৃণালিনী রান্না করতেন অপূর্ব। তাঁর হাতের 'চিঁড়ের পুলি' খেতে খুব ভালোবাসতেন রবীন্দ্রনাথ। আসলে, পুব-বাংলার রান্নার ওপর অদ্ভুত একটা টান ছিল তাঁর। সেখানকার কোন মেয়ে-বৌয়ের সঙ্গে আলাপ হলেই দু'একটি কথার পরেই জিজ্ঞেস করে বসতেন, তুমি রান্না করতে জানো? সেবার কথায় কথায় একটি বউকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, তুমি 'চই' দিয়ে কই মাছ রাঁধতে জানো?
বউটি কথাটা ঠিক বুঝতে পারল না। বলল, 'চই' আবার কি? রবীন্দ্রনাথ বললেন, ওমা, 'চই' জানো না? 'চই' হল এক ধরণের গাছের শেকড়। আমার মামাবাড়ি-শ্বশুরবাড়ি দুইই তো পুব-বাংলায়, সেখানকার মেয়ের হাতেই খেয়েছি 'চই' দিয়ে কই মাছ্। আহা, কী স্বাদ! আশ্রম-কর্মী সুধীরচন্দ্র করের দেশের বাড়ি ফরিদপুর। সেখান থেকে তাঁর মা কামিনীসুন্দরী একবার শান্তিনিকেতনে এলেন। প্রায়ই অপূর্ব সব পদ আর পিঠে বানিয়ে ছেলেকে খাওয়াতে লাগলেন। পাড়াপড়শিরাও বঞ্চিত হলেন না। কামিনীদেবীর খুব ইচ্ছে কবিকেও একদিন রেঁধে খাওয়ানোর, কিন্তু সাহস হয় না; পাড়াগেঁয়ে ঘরোয়া রান্না কি কবির পছন্দ হবে! ওদিকে কামিনীদেবীর রান্নার সুখ্যাতি কানাঘুষোয় ঠিক রবীন্দ্রনাথ অব্দি পৌঁছে গেল। ভাবলেন, খবর যখন এলো, তখন খাবারও নিশ্চয় আসবে। আশায় আশায় কয়েকটা দিন কাটল। কিন্তু, তাঁকে হতাশ করে খাবার আর এলো না। শেষমেশ থাকতে না পেরে একদিন করমশাইকে রবীন্দ্রনাথ বলেই ফেললেন, শুনলাম দেশ থেকে তোমার মা এসেছেন, তিনি যে যত্ন করে রেঁধে খাওয়াচ্ছেন, সেটা অবশ্য তোমার চেহারা দেখে বোঝাই যাচ্ছে।
ব্যস, ইঙ্গিতটা বুঝতে আর বাকি রইল না। কবির ইচ্ছের কথা শুনে কামিনীদেবীর আনন্দ আর ধরে না। জানলেন, কম মশলায় ঘরোয়া রান্নাই গুরুদেবের পছন্দ। বাড়িতে সেদিনই হয়েছে ঝিঙে পাতুরী, মাছের মুড়ো দিয়ে ডাল, সুক্তো, আম ডাল, মাছের ঝোল। সেইসঙ্গে পাটিসাপ্টা আর রসমাধুরী তো আছেই। তাহলে আর দেরি কেন! তক্ষুনি সমস্ত খাবার গুছিয়ে তিনি মহা-উৎসাহে হাজির হলেন গিয়ে সোজা একেবারে কবির খাবার টেবিলে। কবি তখন সবে খেতে বসেছেন। তাই দেখে কামিনীদেবী আমতা আমতা করে বললেন, আজ বাড়ির খাবার না-হয় নাই খেলেন, বরং এগুলো একটু চেখে দেখুন।
পছন্দের পদ আর পিঠে দেখে কবির পক্ষেও লোভ সামলানো মুশকিল হল। হেসে বললেন, সে আর বলতে! তক্ষুনি বাড়ির খাবার সরিয়ে দিয়ে কামিনীদেবীর আনা সুক্তো দিয়ে ভাত আর পিঠে-পুলি ভারি তৃপ্তির সঙ্গে খেতে শুরু করলেন কবি। খেতে খেতে চলতে লাগল কামিনীদেবীর সঙ্গে আলাপ আর তাঁর রান্নার সুখ্যাতি। রবীন্দ্রনাথ খেয়ে তৃপ্ত হলেন, কামিনীদেবী খাইয়ে। আসলে, রবীন্দ্রনাথ পরিমাণে খেতেন খুব কম, একসঙ্গে নানারকম পদ একটু একটু করে খেয়ে খুশি হতেন বেশি।
কবি মাছ-মাংস তেমন পছন্দ করতেন না। তাই জন্মদিনে সেবার কবির জন্য অনেকেই নানান নিরামিষ পদ বানালেন। খাবার টেবিলে প্লেটে-বাটিতে থরে থরে সাজানো হল পদ। অত পদ দেখে কবির তো ভারি আনন্দ। পদ-কর্ত্রীরা সব ঘিরে দাঁড়িয়ে। কবি চাখতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন, কারটি কেমন হয়েছে। কিন্তু, থেমে গেলেন বিশেষ একটি পদে এসে। পদটি বানিয়েছেন ডাক্তার শচীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী। ‘কুমড়োর জেলি’। রবীন্দ্রনাথ জীবনে প্রথমবার খেলেন এমন পদ। এবং, শেষবারও বটে। মুখে নিয়েই মনে হল, না-নিলেই বরং হতো ভালো! ফেলতেও পারেন না, খেতেও পারেন না! অসহায় ভাবে তাকালেন ডাক্তারগিন্নির দিকে, দেখলেন, তাঁর চোখে-মুখে প্রশংসার আশা। মনটি ভেঙে দিতে কবির মন চাইল না; কোনরকমে ঢোঁক গিলে বললেন, 'ভালো! 'খাদ্য-বিড়ম্বনার এখানেই শেষ নয়। অবশ্য, একবার এমনই এক বিড়ম্বনায় পড়ে একজনের মন-ভাঙতে বাধ্য হয়েছিলেন কবি। পিঠে খাইয়ে ভদ্রমহিলা কবিকে 'কেমন হয়েছে' বলার জন্য ঘ্যানর ঘ্যানর করে এমন চেপে ধরলেন যে, কবি সত্যটা বলেই ফেললেন :
'লোহা কঠিন, পাথর কঠিন, আর কঠিন ইষ্টক,
তার অধিক কঠিন কন্যে তোমার হাতের পিষ্টক!'
রন্ধন-কেলেঙ্কারিতে রবীন্দ্রনাথও কম যাননি। কলা এবং আমসত্ত্ব দুধে দলে যে কবির কাব্যচর্চার শুরু, তিনি যে নিত্যনতুন অভিনব পদ উদ্ভাবন করবেন, তাতে আর বিচিত্র কি! একবার মাথায় এলো, আলু-কড়াইশুঁটি সেদ্ধ করে একসঙ্গে মেখে বড়া করতে হবে। ব্যস, লেগে পড়লেন। মৃণালিনী অযাচিতভাবে সাবধান করতে গেলেন, আলু-কড়াইশুঁটির সঙ্গে বেসন বা ময়দা না-মেশালে কিন্তু ভাজা যাবে না। তাতেই কবির রোখ চেপে গেল। কেন যাবে না, আলবাত যাবে! আর সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে মৃণালিনীকে দেখিয়ে দিতে আধ কড়াই তেল চাপিয়ে কবি নিজেই বড়া ভাজতে বসলেন। কিন্তু, যতই তেলে বড়া ছাড়তে লাগলেন, আলু ও কড়াইশুঁটি কিছুতেই গোল আর হয় না, কড়াইজুড়ে ঝুরো ঝুরো হয়ে ছেতরে যেতে লাগল! কবি ঘেমেনেয়ে নাজেহাল হয়ে গেলেন, কিন্তু, বড়া হল না! তাই দেখে মৃণালিনী হাসতে হাসতে বললেন, এবার হল তো! কবির গলাতেও দারুণ হতাশা, হল আর কই! কিন্তু, কথাটা বলেই মনে হল বিপক্ষের কাছে এভাবে ধরা পড়াটা ঠিক হচ্ছে না। অমনি গম্ভীর হয়ে বললেন, কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! তাতে অবশ্য মৃণালিনীকে দমানো গেল না, তিনি হো হো করে হেসে ফেললেন।