খাদ্যরসিক নেতাজি

আজও আবেগের নাম সুভাষ, তাঁকে নিয়ে এখনও অনির্বাণ উৎসাহ রয়েছে বঙ্গে। আহারের বাহারে আমরা বাঙালিরা বরাবরই মুগ্ধ হই। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বিবেকানন্দ, জগদীশ চন্দ্র থেকে শুরু করে সুভাষ চন্দ্র প্রত্যেকেই ছিলেন খাদ্য রসিক। কেমন ছিলেন ভোজনরসিক সুভাষ চন্দ্র...

সুভাষ চন্দ্র আদ্যন্ত বাড়ির খাবার খেতে পছন্দ করতেন। তাঁর প্রিয় খাবারের তালিকায় একদম প্রথম সারিতে ছিল সিদ্ধ ভাত। প্রতিদিনের খাবারে সাধারণ ডাল ভাত থাকতই, মুগ ডাল বেশি ভালবাসতেন। প্রতিদিন খাবার শেষ পাতে টক দই খেতেন। শোনা যায়, দেশবন্ধুর স্ত্রীকে মাতৃজ্ঞানে শ্রদ্ধা করতেন নেতাজি। তাঁর হাতের রান্না খেতে খবুই ভালবাসতেন সুভাষ চন্দ্র।

তিনি চা পান করতে খুবই ভালবাসতেন, জনশ্রুতি রয়েছে তিনি দিনে নাকি ২০ থেকে ৩০ কাপ পর্যন্ত চা পান করতেন। চায়ের পাশাপাশি বিদেশে থাকাকালীন কফিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। মিষ্টির প্রতি তাঁর অসীম আকর্ষণ ছিল। কলকাতার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির দোকানগুলিতে তিনি নিয়মিত যেতেন। ১৯৩৮-৩৯ সাল নাগাদ মুর্শিদাবাদ থেকে একখানা পেল্লাই সাইজের ছানা বড়া উপহার দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। তাঁর প্রিয় মিষ্টির তালিকার মধ্যে ছিল চমচম, নানান পিঠেপুলি, সন্দেশ, রসগোল্লা প্রভৃতি। তবে বাড়িতে তৈরি মিষ্টি খেতে বেশি পছন্দ করতেন। সেই তালিকায় ছিল রস বড়া, চিনির পুলি, মুড়ির নাড়ু , তিলের নাড়ু, নারকেল নাড়ু, মনোহরা, তিলের তকতি ইত্যাদি।

প্রথম দিকে আমিষের খাবারের প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল। মাছ খেতে বড্ড ভালবাসতেন। পরে অবশ্য নিরামিষ খাবারের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। মা প্রভাবতী দেবীকে লেখা চিঠি থেকে সেকথা জানা যায়। ফলে মতে কলা, আপেল, আঙুর খেতেন। মুখশুদ্ধি হিসেবে সুপারী খেতেন, এমনকি ব্যাডমিন্টন খেলার সময়েও মুখের মধ্যে সুপারী রাখতেন।

তবে গোটা কলকাতা জুড়ে অজস্র শতাব্দী প্রাচীন খাবারের দোকান ছড়িয়ে রয়েছে যেখানে নিয়মিত নেতাজির পা পড়ত। ছাত্রবস্থায় নিয়মিত কফি হাউসে যেতেন এবং সেখানকার চিকেন কাটলেট ছিল তাঁর প্রিয়। সূর্য সেন স্ট্রিটের ফেভারিট কেবিন মাঝেমধ্যেই হানা দিতেন, আজও কেবিনে ৪ নম্বর টেবিলটি যত্নে রেখেছেন মালিকপক্ষ।

 

FoodLoverNetaji1

 

ঐখানেই বসতেন দেশনায়ক। সময়টা ১৯১৫, তখনও আজকের মতো জমে ওঠেনি কলেজস্ট্রিট, হাতেগোনা কয়েকটা হোটেল ভরসা। সেই সময় চাকরির খোঁজে উড়িষ্যা থেকে এক তরুণ কলকাতায় এসে পৌছাল। কিন্তু চাকুরি জোটেনি। রান্না করার বিদ্যেকে পাথেয় করে সে খুলে ফেলল হিন্দু হোটেল। তাঁর নাম মানবেন্দ্র নাথ পান্ডা

অল্প কদিনেই মানব ঠাকুরের হোটেলের রান্না লোকপ্রিয় হয়ে উঠল। খানার খবর পৌঁছল প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র সুভাষচন্দ্র বসুর কানে। ওড়িয়া ঠাকুরের হাতের রান্নার স্বাদ পেতে সুভাষচন্দ্র আসলেন মানব পাণ্ডার হোটেলে। সে সময় আজকের মতো চেয়ার টেবিলে খাওয়ার রেওয়াজ ছিল না। হাঁটু মুড়ে বসে কলাপাতায় ভুড়িভোজ চলল। মনপসন্দ স্বাদ পেতে কলেজ পড়ুয়া সুভাষচন্দ্র প্রায়ই ক্লাসের ফাঁকে চলে আসতেন মানবেন্দ্র পাণ্ডার হোটেলে।

শুধু নিজে নয়,বন্ধুরাও সঙ্গে আসতেন। পুঁই-শাকের চচ্চড়ি, মৌরলা মাছ, বেগুন পোড়া, কাটা দিয়ে ডাল ছিল সুভাষচন্দ্র বসুর প্রিয় পদ। শোনা যায় রাজনৈতিক গুরু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকেও তিনি এখানে নিয়ে আসতেন৷ এখানেই নিজের হাতে শতরঞ্চি পেতে বন্ধুদের নিয়ে মাছ ভাত খেয়েছেন নেতাজি। ১৯২৭তে হোটেলটি আজকের ঠিকানায় ৮/২ ভবানী দত্ত লেন-এ উঠে আসে।

এরপর দেশ স্বাধীন হয়েছে, সে দিনের হিন্দু হোটেল নাম বদলে স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল হয়েছে। মানবেন্দ্র পাণ্ডাই নাম পাল্টে দিয়ে গিয়েছে। আজও স্বমহিমায় চলছে স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল। সুভাষচন্দ্র বসু বাটা মশলার রান্না পছন্দ করতেন। এখনও সেভাবেই রান্না হয়। নানা রকম সবজির তরকারি এখানকার স্পেশালিটি।

নেতাজির আরেক প্রিয় খাবার হল চপ। ১৯১৮ সাল বিহারের গয়া থেকে কলকাতায় পা রাখলেন খেঁদু সাউ। ঐ বছরই স্টার থিয়েটার থেকে ঢিলছোঁড়া দূরত্বে উত্তর কলকাতার একচিলতে গুমটিতে তেলেভাজার দোকান দিলেন সাউ। ঐ বছরই এআইসিসি-র কর্ণধার নিযুক্ত হয়েছিলেন নেতাজী সুভাষ।

পিঁয়াজি, বেগুনি, কাশ্মীরি চপ ভাজা শুরু হল। স্বাদের কথা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ল। মানুষ মজল চপে। সেই সময় চপ, তেলেভাজা পরিবেশন করা হত শালপাতায়। খেঁদু সাউয়ের জনপ্রিয়তায় ভিড় বাড়তে লাগল। শালপাতার ঠোঙা হয়ে উঠল লড়াইয়ের প্রতীক, স্বাধীনতা সংগ্রামের বহু তথ্য চালাচালি হয়েছে এই শালপাতায়।

 

FoodLoverNetaji2

 

খেঁদু নিজেও জড়িয়ে পড়এছিলেন স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে। ক্রমশ ভিড়ের মাঝে থেকে ভেসে আসা তথ্য বিপ্লবীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ভার নিলেন খেঁদুবাবু নিজেই। ক্রমশ খেঁদু সাউয়ের দোকান হয়ে উঠল বিপ্লবীদের আখড়া, তথ্য চালানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান। স্বদেশী আন্দোলন করার জন্য খেঁদু সাউকেও দু'বার জেলে যেতে হয়েছে। ‌

দোকানের খ্যাতি যখন ছড়িয়ে পড়ত শুরু করল তখন খেঁদু সাউ ছেলের নামে দোকানের নাম রাখলেন 'লক্ষ্মীনারায়ণ সাউ অ্যান্ড সন্স'। স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া এই লক্ষ্মীনায়ারণ অ্যান্ড সন্সের তেলেভাজায় মুগ্ধ ছিলেন স্বয়ং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু৷ দোকানের আশপাশে তখন স্বদেশীদের মিটিং বসত। মিটিংয়ের মুড়ি, তেলেভাজার বরাত পেতেন খেঁদু সাউ। তেমনই একটি মিটিংয়ে তাঁর সঙ্গে স্বয়ং নেতাজির সাক্ষাৎ হয়।

খেঁদুর হাতের বানানো চপ খেয়ে নেতাজি আল্লাদে আটখানা। খেঁদু তখন নেতাজির সাক্ষাৎ পেয়ে মুগ্ধ। তারপর থেকে ১৯৪২ সাল থেকে প্রতি বছর নেতাজির জন্মদিনে বিনে পয়সায় চপ বিলি করতে শুরু করলেন খেঁদু সাউ। মনে করা হয় নেতাজীর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ  হয়েই খেদু সেদিন স্বদেশিদের পত্রবাহকও হয়েছিলেন। মোহন কুমার গুপ্ত কথায়, 'নেতাজী যখন স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়তেন তখন বন্ধুদের সঙ্গে আসতেন এই দোকানে। চলত আড্ডা, বিপ্লবের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা। আমার দাদু স্বদেশীর গোপন চিঠিও হাতবদল করেছিলেন ছিলেন কয়েকবার'

২৩ জানুয়ারি সকাল হলেই পরিচিত মহল, বন্ধু-বান্ধবদের কাছে নেতাজির গুণকীর্তন করতে করতে বিতরণ করতে শুরু করতেন চপ, ফুলুরি, পিঁয়াজি খেদু। স্বাধীনতার পর বদলে গেল বিতরণের ধরণ। নেতাজির জন্মদিনে দোকান থেকেই কচিকাঁচাদের জন্য দুটো এবং বড়দের জন্য চারটে করে তেলেভাজা বিতরণ শুরু ‌হল।

সেই ঐতিহ্যে ভাঁটা পড়েনি, আজও লক্ষ্মীনারায়ণের পরিবার ২৩ জানুয়ারি বিনে পয়সায় চপ বিতরণ করেন। সকাল সাতটা থেকে দুপুর তিনটে পর্যন্ত চলে তেলেভাজা বিতরণ। দোকানের সাইনবোর্ডেও জ্বলজ্বল করে নেতাজির ছবি। একইভাবে ঐতিহ্য বজায় রেখে রমরমিয়ে চলছে লক্ষ্মীনারায়ণ সাউয়ের তেলেভাজা। হাতিবাগান থেকে হেদুয়ার দিকে যেতে ডান হাতে পড়বে এই দোকান। রকমারি চপের স্বর্গরাজ্য এটি, চিরাচরিত আলুর চপ, কাশ্মীরি চপ, বেগুনি, ধোঁকা ইত্যাদি তো রয়েছেই, তালিকায় আমের চপ, পনিরের চপ, চাউমিনের চপের মতো অভিনব পদ সংযোজিত হয়েছে।

তবে আরেক পদের কথা বলে আজকে দেশনায়কের খানার সাতকাহন শেষ করব। বিনোদ ঠাকুরের হোটেলের মৌরলার লটপটির স্বাদে মজেছিলেন নেতাজি। ভোজন রসিকরা আজ এক ডাকে বিনোদ ঠাকুরের সাবেক হোটেলটিকে চেনেন। এই হোটেলের কাঁটাচচ্চড়ি, মুড়ি ঘণ্ট, ধোকার ডালনার, মেটে চচ্চড়ির সুখ্যাতি সর্বজনবিদিত।

বাঁকুড়ার রাইপুরের শ্যামসুন্দরপুর গ্রামের বিনোদবিহারী আচার্যের বিনোদ ঠাকুর হয়ে ওঠার পথে ছিল প্রতিকূল। অভাবী ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান বিনোদবিহারী মাত্র নয় বছর বয়সে গ্রামের এক কাকার সঙ্গে  ঝাড়গ্রামে চলে আসেন। কিছু দিন পরে শিলদা-ঝাড়গ্রাম রুটের বাসে সহকারী খালাসির কাজ জুটিয়ে নেন। বাসের চালক শ্রীরাম নায়ডু ছিলেন ভোজন রসিক। দীর্ঘ দিন বাংলায় থাকার সুবাদে শুক্তো, পাতুরি, চচ্চড়ি, ঘণ্টর অনুরাগী হয়ে উঠেছিলেন দক্ষিণ ভারতীয় মানুষটি।

বিনোদবাবু স্মৃতিচারণায় বলতেন, ‘নায়ডুর জন্যই কিশোর বয়সে আমাকে হাতা-খুন্তি ধরতে হয়েছিল।’ একের পর এক পদ নিজের মতো করে রাঁধতেন বিনোদবিহারী। হাতের গুণেই ১৮ বছর বয়সে ঝাড়গ্রামের জামবনি ব্যারাকের কাছে একটি খাবার হোটেলে রান্নার কাজ জুটে গেল। স্বপ্ন দেখতেন নিজেই এক দিন খাবার হোটেল খুলবেন। ১৯৩৩ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে ঝাড়গ্রাম মেন রেল ক্রশিংয়ের কাছে রাস্তার ধারে মাটির দেওয়াল আর খড়ের ছাউনি দেওয়া ভাতের হোটেল খুলে বসলেন। তারই মধ্যে বিনোদবিহারী হয়ে গিয়েছেন বিনোদ ঠাকুর।

দীর্ঘ দিন নিজের হাতেই হোটেলের সব রান্না করতেন। উদ্দেশ্য ছিল ভাল মানের রান্না সরবরাহ করা। সাবেক বাঙালি পদের রান্নাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। পরে ইটের গাঁথনি দেওয়াল, কাঠের পাটাতন দেওয়া সিলিং আর অ্যাসবেসটসের ছাউনি দেওয়া হোটেল তৈরি হয়। আজও সাবেক কাঠের টেবিল আর বেঞ্চে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। কয়েকটি মার্বেল বসানো কাঠের ছোট টেবিল আজও রয়েছে এখানে। এই রকমই এক টেবিলে বসে খেয়ে গিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র।​

​সময়টা ১৯৪০। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। জাতীয় রাজনীতিতে তখন গান্ধী-সুভাষ মতবিরোধ। ঈর্ষার শিকার হওয়া সুভাষচন্দ্রের দূরত্ব তখন স্পষ্ট। ওই বছর ১২ মে ঝাড়গ্রামে এক জনসভায় বক্তব্য রাখেন সুভাষচন্দ্র। অবিভক্ত মেদিনীপুরে সেটিই ছিল দেশনায়কের শেষ জনসভা। ওই সভায় সুভাষচন্দ্রের সঙ্গী ছিলেন নাড়াজোল এস্টেটের কুমার দেবেন্দ্রলাল খান। সভার আগে দুজনে মিলে ঝাড়গ্রামের শান্তিনিকেতন হোটেলে দুপুরে আহার করেছিলেন। বিনোদ ঠাকুরের উত্তরসূরিদের দাবি অনুযায়ী, হোটেলের ৩৮ নম্বর টেবিলে বসে সর্ষে-পোস্ত-কাঁচালঙ্কা বাঁটা দিয়ে মুখরোচক মৌরলা মাছের লটপটি পদটি পরম তৃপ্তিসহকারে খেয়ে গিয়েছিলেন ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত সুভাষচন্দ্র।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...