লালকেল্লার রান্নাঘরে মিলে মিশে একাকার ভারত, মিশর, পারস্য

বাবর যখন ভারতে এসেছিলেন সেসময়ের মুঘল রাজ দরবারে উজবেকিস্থানের সংস্কৃতির বহুল প্রভাব ছিল। বাবরের ভারতীয় খাবার-দাবারের প্রতি সেভাবে টান জন্মায়নি। যদিও তিনি ছিলেন ভোজন রসিক কিন্তু পারসি স্বাদের পরিসর থেকে বেরতে পারেন নি সেভাবে। উপরন্তু ভারতে বরফ, ঠাণ্ডা জল। আঙ্গুর, আখরটের অভাব তাঁকে বেশ সমস্যায় ফেলেছিল বলা যায়। বাবর তাই ভেড়ার মাংসের বিভিন্ন পদেই সন্তুষ্ট থাকতে হত। এমনিতেই বেশিরভাগ সময় যুদ্ধ-বিগ্রহ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তাঁবু জীবন কাটাতে হত। সেখানে মশলার উপকরণ বিশেষ পাওয়া যেত না। তাই সেই এক ঘেয়ে বিস্বাদ মাংসকে যাযাবর উপজাতিদের কায়দায় পুড়িয়ে বা সেঁকে রান্না করা হত। কী পদ্ধতিতে প্রস্তুত করা হবে তা নির্ধারণ করতেন সম্রাট বাবার নিজেই।

FotoJet (27)

বাবারের রন্ধন প্রীতি নিয়ে একাধিক গল্প প্রচলিত আছে। ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করেছিলেন ।ক্ষুরধার বুদ্ধির বাবর শত্রুর সমস্ত খবর নখদর্পনে রাখতেন। তিনি জানেন ইব্রাহীম লোদীর পাচক হিন্দুস্থানী এবং সেই ব্যক্তি অসাধারণ রন্ধনশিল্পী। লোদিকে পরাস্ত করে লোদি সাম্রাজ্য দখলের পর সেই পাচককে বাবর নিজের হেঁশেলে নিয়োগ করেছিলেন। তাঁর হাত ধরেই ্মুঘল বাদশার হেঁশেলে ভারতীয় পদ প্রবেশ করে। তাঁর হাতে যাদু ছিল। বাবর মুগ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু একদিন বাদশার খাবারে বিষ মেশানোর চক্রান্তে ধরা পড়লেন সেই পাচক। বাবর প্রাণে বেঁচে যান, সেই পাচকের মৃত্যুদন্ড হয়। তারপর থেকে মুঘল হেঁশেলে হিন্দুস্থানি পাচক রাখার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।

তবে পরবর্তী শাসক হুমায়ুন নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করেন। তাঁর আমলে বাদশার রান্নাঘরে আবার হিন্দুস্থানি পাচক ফিরে আসে।

FotoJet (29)

মুঘল বাদশারা প্রত্যেকেই ভারতীয় খাবারের প্রেমে মজে ছিলেন। প্রত্যেকেই নিজের মতো করে রান্নায় ‘এক্সপেরিমেন্ট’ চালান। কখনও খিচুড়ি কখনও খরগোসের মাংস কখনও বা মিষ্টির পদ পরীক্ষা-নিরিক্ষা চলতই। তবে শাহজাহান একমাত্র বাদশাহ যিনি রান্নার ওপর একটা আস্ত বই লিখেছিলেন।

মুঘল হেঁশেলের সঙ্গে যুক্ত কোনও ব্যাক্তি তাঁর শাসন কালেই এই বইয়ের পরিকল্পনা করেন। নুসকা-ই-শাহজাহানি ফার্সিতে লেখা। শাহজাহানের আমলেই বইটি লেখা হয়েছিল।

ভারত, মিশর, পারস্য, মধ্যপ্রাচ্য মিলে মিশে এক হয়ে যায় শাহজাহানের হেঁশেলে। দমপোক্ত, কাবাবের টেকনিক এই মুঘল আমল থেকেই ভারতের খাদ্যরসিকদের পছন্দের তালিকায় ঢুকে পড়ে। কিন্তু এসবই ছিল আমির ওমরাহ ভোজনবিলাসের সামগ্রী।

মুঘল হেঁশেলে কী রান্না হবে, কোন সময়ে কী খাওয়া উচিত সে সব স্থির করতেন হাকিম। ঔষোধী গুণ আছে এমন সব উপকরণ ব্যবহার করা হত দৈনন্দিনের রান্নায়।

FotoJet (31)

জায়ফল ,জয়িত্রী, জাফরানের ব্যবহার ভারতীয়রা শেখে মুঘলদের থেকেই। বাবরের প্র-পৌত্র শাহজাহান সিংহাসনে আরোহণ করার পর মুঘল রাজপ্রাসাদের রান্নাঘরে টম্যাটো এবং কাঁচালঙ্কা আসতে শুরু করে। তাঁর রাজসভায় আসা পর্তুগিজ বণিকদের থেকে। শাহজাহানই প্রথম কাঁচালংকার সঙ্গে মুঘল ঘরানার পরিচিতি করান। বাদশার জন্য পোলাও রান্নার যে চাল ব্যবহার করা হত তাতে রূপোর তবক দেওয়া থাকত।

রান্না ঘরে প্রায় একশো জনেরও বেশি সহায়ক কাজ করত। গঙ্গার জল এবং বৃষ্টির জল মিশিয়ে রান্না হত। পদের স্বাদ এবং গন্ধ যাতে আকর্ষণীয় হয় তার জন্য এই পন্থা। বৃষ্টির জল সংরক্ষন করা হত রান্নার প্রয়োজনে। দশম-একাদশ শতাব্দীতে ভারতীয় খাদ্য সংস্কৃতির সঙ্গে মুঘল খাদ্য সংস্কৃতির মেলবন্ধনে এক ভিন্ন স্বাদের জন্ম হয়। ভর্তা, খিচুড়ী, পুরি, চিল্লর(বেসনের রুটি), পান, সরষের তেল, , মিছরি, মুলতানি মাটি মুঘল রান্নার জরুরি সামগ্রী হয়ে দাঁড়ায়। ভারতীয় ফলেরও কদর বাড়ে।

FotoJet (28)

পরবর্তী সময়ে দরবারী খাবার সাধারণের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় রন্ধন চর্চার একটি অন্যতম অধ্যায় হয়ে ওঠে মোগলাই খাবার। ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে সমাদৃত হয়।  

 

 

 

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...