"চল টুসু চল খেলতে যাব রাণীগঞ্জের বটতলায়
খেলতে খেলতে দেখে আসব কয়লা খাদের যন্ত্রণা"
প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্ঠে এই গান প্রায় সকলেরই শোনা।
টুসু পুজোকে কেন্দ্র করে নারীরা তাদের সুখ-দুঃখ, মান-অভিমান, আনন্দ-বেদনা-বঞ্চনা-হতাশা গ্লানিকে গানের মাধ্যমে তুলে ধরে। টুসু গানের মধ্যে নারী খুঁজে পায় তার যন্ত্রণা প্রকাশ করার আধার। কারণ টুসু যে তাদের ঘরের মেয়ে। বাড়ির মেয়ের সঙ্গে কষ্ট ভাগ করে নেওয়া যে সহজ।
পশ্চিম বাংলার পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চল অর্থাৎ বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর জেলায় অগ্রহায়ণ সংক্রান্তি থেকে শুরু করে পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত অর্থাৎ সারা পৌষ মাস ধরে টুসু পুজো হয়। কুমারী, সধবা-বিধবরা তুষভরা একটি মাটির সরায় নারী মূর্তি অঙ্কন করে ফুল, মিষ্টি ও নানা উপাচার্য দিয়ে সাজিয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যায় পূজা করে। টুসুকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরণের গান গাওয়া হয়। মকর সংক্রান্তির দিন টুসুকে নদীর জলে বিসর্জন দেওয়া হয়।
টুসু হল ফসলের অনুষ্ঠান। ধান সম্পর্কিত কৃষি উৎসব। অগ্রহায়ণ-পৌষ মাস ধান পাকার সময়। এই সময় গোলা ভরে ওঠে নতুন শস্যে। কৃষকদের কাছে আনন্দের দিন। পশ্চিম বাংলায় একে 'তুষ-তুষলী' ব্রত বলে। 'টুসু' শব্দটি তুষ শব্দ থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়। তুষ আদরার্থে তুষু হয়েছে। মূর্ধণ্যীভবনের ফলে 'ত' 'ট'-তে পরিণত হয়েছে।
এই সময় মেয়েরা বাপের বাড়িতে আসে। মাঠের ধানকে যেমন মাঠ থেকে বাড়িতে আনা হয় তেমনি মেয়েকেও শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি আনা হয়। এই কৃষি উৎসব ধীরে ধীরে সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। ধানকে কন্যার রূপ দেওয়া হয়েছে।
টুসুর মূল পরব পৌষ ও মকর সংক্রান্তি হলেও তার অনেকদিন আগে থেকে এর উদ্যোগ শুরু হয়ে যায়। অনেক সময় পৌষ সংক্রান্তির তিনদিন আগে থেকেই এই উৎসব শুরু হয়। প্রথমদিন মেয়েরা পুরনো মলিন বস্ত্র কেচে পরিষ্কার করে দল বেঁধে স্নান করতে যায়। তারপর স্নান সেরে চাল দিয়ে পুলি তৈরি করা শুরু করে। এইদিন মাছ খাওয়া আবশ্যিক। তাই পুরুষরা মাছ নিয়ে আসে।
নতুন মাটির সরার বাইরে চালের গুঁড়ো মাখিয়ে তাতে চাল দিয়ে উনুনে গরম করা হয়। এই অনুষ্ঠানকে "বাউরি বাঁধা" বলে। বাউরি বাঁধার কাজ শেষ হলে গানের আসর বসে। গানই হল টুসু উৎসবের প্রাণ ভোমরা।
টুসু গানে সমাজ-সংসারের ছবি প্রতিফলিত হয়েছে। টুসু বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের শিকার। তাঁর যন্ত্রণাময় জীবনের প্রতিচ্ছবি মর্মস্পর্শী ভাষায় টুসু গানের মধ্যে ধরা পড়েছে। শাশুড়ি-ননদের অত্যাচারে শিশুর কোমল মন আঘাতগ্রস্ত। তাও গানের ছত্রে ছত্রে ফুটে ওঠে। সমাজনীতি-পরিবারের পাশাপাশি রাজনীতির ছবিও টুসু গানে শোনা যায়।
সারা পৌষমাস ধরে টুসু পুজো করার পর পৌষ সংক্রান্তির দিন চৌদল সাজিয়ে সকলে মিলে টুসুকে নদীর জলে বিসর্জন দেওয়া হয়। তা ঘই সকরুণ কন্ঠে সবাই গেয়ে ওঠে -
"তিরিশ দিন রাখিলাম মাকে
তিরিশটি ফুল দিলেও গো
আর রাখিতে পারব না মাকে
মকর হইল বাদী গো।"