ভারতবর্ষে পটশিল্পের শুরুর ইতিহাস বেশ প্রাচীন। সংস্কৃত শব্দ 'পট্ট' মানে 'কাপড়'। কাপড়ে রঙ করে নানান পুরাণ কাহিনির ছবি এঁকে তা পরিবেশন করে থাকেন এক শ্রেণীর লোকশিল্পী। এই শিল্পই তাঁদের জীবন-জীবিকার প্রধান মাধ্যম। এঁদেরকে বলা হয় 'পটকার' বা 'পটুয়াশিল্পী'।
খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে পটকারের উল্লেখ পাওয়া গেছে। বাংলার মঙ্গল কাব্য বা চৈতন্য আমলেও পটের কথা শোনা যায়। পটের সঙ্গে পটুয়া শিল্পীরা গানও গেয়ে থাকেন। পটচিত্রর মতোই সহজ-সরল সেই গানও। রেখা আর সুরের ধর্ম এক হয়ে যায় পটগায়কের কণ্ঠে।
বিভিন্ন জায়গায় পট পাওয়া গেলেও বাংলায় প্রাপ্ত পট অন্য সব জায়গা থেকে একটি বিষয়ে আলাদা। বাংলায় গান গেয়ে পটে চিত্রিত বিষয় বর্ণনা করেন পটশিল্পীরা। যা সাধারণত আর কোথাও লক্ষ্য করা যায় না।
পট বাদ দিয়ে সঙ্গীত আর সঙ্গীত বাদ দিয়ে পটের কথা ভাবাই যায় না। উভয় একে অপরের সঙ্গে শুধু অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্তই নয়, রস ও সৌন্দর্য্যবর্ধকও বটে। পটগীতির ভাষা অনাড়ম্বর, সহজ, সরল ও বর্ণনাত্মক। ছন্দেও রয়েছে সহজ চলন।
পটের চিত্রের উপর নির্ভর করে গান রচনা করা হয় ফলে গানের বহিরঙ্গে শিথিলতা থেকে যায়। পটের বিষয় অনুযায়ী সুরারোপ করা হয়। বন্দনা দিয়ে সাধারণত পটুয়া সঙ্গীত আরম্ভ হয়। এই বন্দনা শুনলে পটের বিষয়বস্তু কিছুটা হলেও আঁচ করা যায়। বন্দনার পরই মূল কাহিনিতে ঢোকা হয়। গানে আঞ্চলিকতার প্রভাবও স্পষ্ট।
অর্থনৈতিক বিপর্যয়, সামাজিক বঞ্চনা, ব্যভিচার, শাসন-শোষণের প্রতি বিদ্রোহ, প্রতিরোধ ও প্রয়াসও গানের বিষয়বস্তু করা হয়। আবার ভক্তি, প্রেম, বাৎসল্য, দাম্পত্য রসও পটুয়া গানে ফুটে ওঠে।
বেহুলা-লখিন্দরের গল্প, রামায়ণ, ভাগবতের গল্প বিষয় হিসেবে নির্বাচন করা হয়। মহাভারতের গল্প সাধারণত পটের বিষয় হিসেবে দেখা যায় না। এছাড়া জীবনে নীতি ধর্ম শিক্ষা দেবার জন্য রয়েছে 'যমপট', 'যাদুপট', 'চক্ষুদান পট'। এগুলো মৃতব্যক্তিকে কেন্দ্র করে রচিত হয়। 'চক্ষুদান' পট মূলত সাঁওতাল অধিবাসীদের মধ্যে বেশি প্রচলিত।
পট দেখাবার সঙ্গে সঙ্গে পটুয়ারা যে সমস্ত গান গেয়ে থাকেন সে গান পটের বিষয়ানুসারী হয়। এই সব গান তাঁরা বংশ পরম্পরায় পিতা-মাতা বা পূর্বপুরুষ থেকে পেয়েছেন। আবার নিজেরাও রচনা করে নেন। সেদিক দিয়ে দেখলে পটুয়ারা শুধু স্বভাব শিল্পী নয়, স্বভাব কবিও।
অরির পুত্র যমরাজ যম নাম ধরে
বিনা অপরাধে যম কাউরি দস্ত না করে।
একজন বলতে তারা দুই জনে যায়,
কেও ধরে চুলের ঝুঁটি কেও ধরে গায়,
পাপী লোক হলে গো তার মস্তক যাই-ই।
ভাল জল থাকতে যে জন সম্ব জল দেয়,
মৃত্যুকালে নরককুণ্ডে মুখে তার জল দেয়।
এটি একটি যম পটের গান। মৃত্যুকে কেন্দ্র করেই এই পট রচিত। এর মাধ্যমে লোকশিক্ষা দেওয়াই মূল উদ্দেশ্য। পুরাণ বা লোকশিক্ষা ছাড়া ঐতিহাসিক ও সমকালীন ঘটনাও পট ও সঙ্গীত রচনার বিষয় হয়ে ওঠে। যেমন সন্ন্যাসী চোয়াড় গাজী-নীল, সিপাহী-জামাড়িয়া, সাঁওতাল প্রভৃতি বিদ্রোহ, কালীঘাটের পট, সাহেব পট, ডাকাতের পট, অস্পৃশ্যতা বর্জন, পণপ্রথা, পরিবার পরিকল্পনা, দুর্ভিক্ষ, খরা, বন্যা, মহামারী প্রভৃতি এমনকি বিভিন্ন মতাদর্শগত প্রচার পট ও পটুয়া সঙ্গীতে রয়েছে। 'গাজী' পটে গাজী বা মুসলমান ধর্মপ্রচারকদের অলৌকিক জীবন-বৃত্তান্ত চিত্রিত ও গীত হয়।
গাজীর ভাই কালু আইল নিশান ধরিয়া
গাজীর আছে একটা বাঘ নাম যে খান্দিয়া।
ঘর দুয়ার দুলিয়া বাঘে বাঘে মানুষ লইয়া খায়।
চুল নাই বইড়া বিটি খোপার লাইগা কান্দে
কচুপাতা কিপলা দিয়া খোপা ভাঙর করে।
সুন্দরবুইনা বাঘ ছিল আড়ে আড়ে চাস।
তারা বুইনা বাঘ যেমন সেলাম জানায়।
পালের প্রধান বড় আবালটা বাঘে লইয়া যায়।
সাতসের চাইলের পিঠা খাইল বুড়ি কাঁনামুড়ি দিয়া।
দাঁতটিং দাঁতটিং বইলা বুড়ি জামাই বাড়ি যায়।