বাংলার সঙ্গীত ধারায় কীর্তন বেশ পরিচিত আঙ্গিক। বাংলা ও বাঙালির সঙ্গে তা প্রায় লেপ্টে রয়েছে। যেকোন শুভ ঘটনায় যেমন কীর্তন গ্রামবাংলায় পরিবেশিত হয় তেমনি দুঃখেরও সঙ্গী কীর্তন।
কীর্তন গানের সৃষ্টি হয়েছে সুপ্রাচীন কালে। মনে করা হয় আর্য ঋষিরা একটি নির্দিষ্ট ছন্দে সামগান গাইতেন। বৌদ্ধযুগেও চর্যা ও বজ্রগীতকে নির্দিষ্ট তালে ও রাগের মাধ্যমে গান বেঁধে গাওয়া হত।
বৈদিক যুগে যজ্ঞ বেদীকে ঘিরে ঋত্বিক ও তাঁদের স্ত্রীদের সামগান করার প্রথা প্রচলিত ছিল। এর সঙ্গে সাধারণ নারীরাও অগ্নিকুণ্ডের চারদিকে হাত তালি দিয়ে তালে তালে নাচ করত। মনে করা হয় পরবর্তীকালে বৌদ্ধসিদ্ধাচার্যগণ এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রাগরাগিণীর মাধ্যমে সংকীর্তনের গান হিসাবে চর্যাগীতি বা বজ্রগীতি নামে এক প্রকার গীতি সৃষ্টি করেন। 'সংকীর্তন' দুটি শব্দবন্ধ দ্বারা তৈরি। সঙ আর কীর্তন। সঙ বলতে অভিনয় বোঝায়। অর্থাৎ নাচ, গান এবং অভিনয়ই
'সংকীর্তন' নামে পরিচিত।
ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহের মতে গীতগোবিন্দ বৈষ্ণব পদাবলীর মূল আদর্শ। চর্যাগীতির আধ্যাত্ম সাধনা সম্বলিত গান আর গীতগোবিন্দের পদগান থেকেই বৈষ্ণব পদাবলীর কীর্তনের প্রতিষ্ঠা। চর্যার অবধূতিকাই সম্ভবত গীতগোবিন্দ ও পদাবলী কীর্তনের শ্রীরাধা হয়েছেন। চর্যাগীতির অনেক উপমা, রূপক, প্রহেলিকা ষোড়শ শতাব্দীর বৈষ্ণব কবিতায় মেলে।
শ্রী কৃষ্ণ ও রাধিকার বিচিত্র আখ্যান ও প্রেমলীলা খ্রীষ্টিয় শতকের শুরু থেকে প্রাকৃত লৌকিক সাহিত্য ও সঙ্গীতরূপে দক্ষিণের বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত ছিল। দক্ষিণ ভারতে 'মুকুন্দমালা' গ্রন্থে কৃষ্ণ ও গোপীদের প্রেমলীলার কথা রয়েছে। অনেকে মনে করেন শ্রীচৈতন্য দক্ষিণ ভারত ভ্রমণকালে সেখানকার ভক্তিভাব দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। দক্ষিণ ভারতে শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলা নিয়ে ছন্দ ও নৃত্যের যুগলবন্দীর মিশেলে গীতিধর্মী ঝুমুর শ্রেণীর গান পাওয়া যায়। এগুলোও রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক এক ধরণের লৌকিক পদাবলী।
বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদ পদাবলী কীর্তনে, সুর- তাল-ছন্দের বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। রাধাকৃষ্ণ লীলা, শ্রীমদ্ভাগবত ও শ্রীকৃষ্ণের মহিমাময় যশোকীর্তি প্রচার গানের মূল বিষয়বস্তু। যশোকীর্তির গান থেকেই কীর্তন শব্দটির আক্ষরিক উদ্ভব ঘটেছে।
শ্রীপদ গোপাল ভট্ট কীর্তন প্রসঙ্গে বলেছেন- নৃত্য, গীত ও বাদ্য সহযোগে রস ও ভাবাবেশে শ্রীভগবানের উদ্দেশ্যে যশোকীর্তির গানই বাংলা বৈষ্ণব-সমাজে 'কীর্তন'। আবার শ্রীল রূপ গোস্বামীর মতে "নাম গুণালীলাদিনা মুশ্বৈভার্যা তু কীর্তনম্"। অর্থাৎ উচ্চস্বরে শ্রীভগবানের নাম, গান, গুণ ও লীলার প্রচারই হল কীর্তন।
শোনা যায় চণ্ডীদাসের 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' ও জয়দেবের 'গীতগোবিন্দ' শুনে শ্রীচৈতন্যদেব ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়তেন। ভগবানের লীলা প্রচারের উদ্দেশ্যে শ্রীচৈতন্য নামগান অথবা সংকীর্তন নামে এক বিশেষ সাঙ্গীতিক রূপের প্রবর্তন করেন।
নৃত্য, নগর-কীর্তন মহাপ্রভুর শ্রেষ্ঠ কীর্তি। মৃদঙ্গ, মন্দিরা, মাদল, শঙ্খ, কাঁসর প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সংকীর্তনের ধারার প্রবর্তন হয়।
"চৈতন্য চন্দ্রের এই আদি সংকীর্তন
ভক্তগণ গায় নাচে শ্রীশচীনন্দন।"
শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তরঙ্গ পারিষদ স্বরূপ দামোদর মহাপ্রভুর প্রিয় এই গায়নরীতিকে আরও মাধুর্যমণ্ডিত করে পরিবেশন করেন। কীর্তনে বহু প্রকারের তাল ও মাত্রা দেখা যায়। বর্তমানকালে উচ্চাঙ্গ কীর্তনে দশকুশী, ডাঁশ পাহিড়া, ধামালী, দুঠুকী, তেওট, অষ্টমান প্রভৃতি একশ আট প্রকার তাল ব্যবহার হয়ে থাকে। শ্রীচৈতন্যের সময় থেকেই নামকীর্তন ও লীলাকীর্তন এই দ্বিবিধ রূপের প্রকাশ হয়েছে।
কীর্তনে অনেক রাগ রয়েছে। কামোদ, গৌরী, টোড়ী, শ্রী, কানাড়া, ভূপালী, আড়াপা, সৌহিনী, মল্লার, আশাবরী, ভৈরবী, বসন্ত, পটমঞ্জরী, গুর্জরী, কালেংড়া, বেহাগ, বেহাগড়া, কল্যাণী, সারৎ, ভাটিয়ারী, সুরাট, মল্লার, বসন্ত বাহার, ইমনকল্যাণ ইত্যাদি ভারতীয় শাস্ত্রীয় রাগরাগিণীর আধারে কীর্তনের প্রচলন দেখা যায়।
চৈতন্যদেবের মৃত্যুর পর ক্রমশ কয়েকটি রীতিতে কীর্তন প্রচারিত হতে থাকে। গৌরচন্দ্রিকা নামের এক নতুন রীতি প্রবর্তিত হয়ে বিলম্বিত লয়ে ধ্রুপদীয় ভাবধারায় 'পদাবলী কীর্তন' নামের এক বিশেষ কীর্তন শৈলি প্রচলিত হয়। ঝুমুরাশ্রিত কৃষ্ণ ও চৈতন্য নামগুণগান আজ বাংলাদেশে কীর্তন নামে সুপরিচিত হয়ে উঠেছে