মাটির সোঁদা গন্ধ চুঁইয়ে পড়ে। গায়ে লেপ্টে থাকে আপনজনের পরশ। মাদকতায় ভেসে যেতে চায় মন। বোলের দুলকি চালে শুধু মন নয়, নেচে উঠতে চায় দেহও। ঝুমুর গানে মিশে আছে প্রান্তিক মানুষের রাগ-অনুরাগ আর ভালোবাসা। মালভূমি অঞ্চলের রুক্ষ্মতায় আরও রূপসী হয়ে উঠেছে "ঝুমুর"। লোক সঙ্গীতের বিপুল বিচিত্র আঙিনায় "ঝুমুর" একটি মূল্যবান রত্ন।
ছোটনাগপুর থেকে আরম্ভ করে সমগ্র মধ্যভারত, গুজরাটের সীমান্ত পর্যন্ত বসবাসকারী আদিবাসীদের মধ্যে ‘ঝুমুর’ গান প্রচলিত। সুগভীর অরণ্যাকীর্ণ পর্বত ও নীরস প্রস্তরভূমি এই গানকে অনন্যতা দান করেছে। ভাষাগত পার্থক্য এই গানের রস আস্বাদনে কোন বাধাই সৃষ্টি করতে পারে না। সুরের মাদকতায় মন ভেসে যেতে চায়।
সীমান্ত অঞ্চলের আদিবাসী জাতি সাঁওতাল। তাদের মধ্যেও ঝুমুর গান শোনা যায়। তবে বাংলা লোকসঙ্গীত ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রভাবে ঝুমুর গানের রূপ, ভাব ও সুরের কিছুটা হলেও পরিবর্তন ঘটেছে।
সাধারণভাবে ঝুমুর গান তিন পদের। বাদ্যযন্ত্র হিসেবে মাদল ও বাঁশির সুর শোনা যায়। রূপকের ব্যবহার ঝুমুর গানের একটি বৈশিষ্ট্য।
আধ্যাত্মিক চিন্তা ঝুমুর গানে সেভাবে প্রায় দেখা যায়ই না। জীবনের তুচ্ছ ঘটনার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও মাঝে মাঝে গানে উঠে আসে। কোন কোন ঝুমুর গানে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলাও প্রকাশিত হয়েছে। রামলীলা, পৌরাণিক বিষয় নিয়েও ঝুমুর গান রচিত হয়। কাহিনি প্রধান ঝুমুর গান পাঁচালির সুরে এবং ভাব প্রধান গান লৌকিক সুরেই সাধারণত গাওয়া হয়।
আধুনিক ঝুমুর গানে আবার বৈষ্ণব পদাবলীর মতো কবির নাম বা ভণিতা থাকে। ভবপ্রীতা ওঝা, বিনোদ সিংহ প্রমুখ নাম পাওয়া যায়। ঝুমুর গানের তালে তাল মিলিয়ে নাচ করা হয়। নৃত্যের নাম অনুসারে ঝুমুরের নামকরণও করা হয়।
দাঁড়শালিয়া ঝুমুর - যৌথভাবে নাচ করা হয়। করম ও অন্যান্য উৎসবে এই নৃত্য পরিবেশিত হয়। পুরুষ প্রধান নৃত্য। মাদল ও ধামসা সহযোগে গান ও নাচ করা হয়।
"সাঁতার দিছ ভবছলে।
দেখ দহের মাছ না পড়ে জঞ্জালে।"
ছৌ-নাচের ঝুমুর - একসময় ঝুমুর গান ব্যতীত ছৌ নাচ কল্পনা করা যেত না। এখন সঙ্গীতাংশ বাদ দিয়ে শুধু নৃত্যই পরিবেশিত হয়। ছৌ-নাচের ঝুমুর "রঙ ঝুমুর" নামে পরিচিত।
"যমুনাতে ফুল ফুটেছে লাল কালো সাদা
কোন ফুলেতে কৃষ্ণ আছে কোন ফুলে
রাধা।"
খেমটি ঝুমুর - সীমান্ত অঞ্চলে এক শ্রেণী নৃত্য-গীতের মাধ্যমে জীবিকা নির্ধারণ করেন। তাদের "নাচনী" বা "খেমটি" হিসেবে ডাকা হয়। তারা নৃত্যকালীন বা তাদের পৃষ্ঠপোষক রসিকেরা যে গান করে সেটি হল খেমটি ঝুমুর গান।
"তোমার রূপের মাধুরী ভুলিতে না পারি আমি গো..."
পাতানাচের ঝুমুর - এই নাচ আর গানের মাধ্যমে একসময় পুরুষ-স্ত্রী নির্বাচন করা হত। ফলে এই নাচে পুরুষ আর স্ত্রী উভয়ে মিলে অংশগ্রহণ করে। করম উৎসব উপলক্ষে পাতা শুদ্ধু একটি ডালকে কেন্দ্র করে নৃত্য হয় বলে এর নাম পাতানাচ বলে অনেকে মনে করেন।
ঝুমুর কীর্তন - রাজশাহী ও হাপনা জেলার গ্রামগুলিতে ঝুমুর কীর্তনের প্রচলন ছিল। ঝুমুর গানের সঙ্গে এর কোন যোগ নেই আবার কীর্তনের সঙ্গেও তেমন কোন মিল নেই। কৃষকরা সারাদিন কাজের পর বাড়ি ফিরে সন্ধ্যায় ত্রিনাথ বা ঠাকুরের উদ্দেশ্যে গান করে। ঝুমুর কীর্তন হল রাধাকৃষ্ণকে নিয়ে গান। খোল, করতাল, কাঁসি, দোতারা, হারমোনিয়াম সহযোগে গান করা হয়। বর্তমানে উত্তর চব্বিশ পরগণা, নদীয়া, মালদহ ও অন্যান্য জেলার কৃষকরা ঝুমুর কীর্তন গেয়ে থাকেন।
লাল মাটির দেশে গেলে ঝুমুর গানের সুবাস ভেসে আসে। তাঁদের পরিশ্রান্ত জীবনে এক চিলতে আনন্দক্ষণ ধরা পরে ঝুমুর গানের বোলের তালে ও মাদকতায়। তাই হয়তো সেই সুর কানে এলে আমাদেরও দেহ-মন দুলে ওঠে।