শিবের গান "গম্ভীরা"

শিব তোমার লীলাখেলা কর অবসান
বুঝি বাচেনা আর জান
অনাবৃষ্টি কইর্যো সৃষ্টি
মাটি করলা নষ্ট হে

শিবের কাছে নিজেদের শোক-সন্তাপ, অভাব-অভিযোগ গানের মাধ্যমে একদল মানুষ দলবদ্ধভাবে প্রকাশ করে। মূলত উত্তরবঙ্গের মালদহ জেলা এবং বাংলাদেশের চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার সাধারণ মানুষের মধ্যে এই গানের রীতি ভীষণভাবে জনপ্রিয়। শিবপুজো উপলক্ষে বিগত বছরের প্রধান প্রধান ঘটনা নৃত্য, গীত ও অভিনয়ের মাধ্যমে শিবের সামনে পরিবেশন করা হয়। এই বিশেষ ধরণের লোক গানকে 'গম্ভীরা' বলা হয়।

প্রাচীন যে সকল ঐতিহ্যবাহী লোকনৃত্য প্রচলিত রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল 'গম্ভীরা'। গম্ভীরা উৎসবের প্রচলন হয়েছে শিবপূজাকে কেন্দ্র করে। শিবের এক নাম 'গম্ভীর' তাই শিবের উৎসব "গম্ভীরা উৎসব" এবং শিবের বন্দনা গীতিই হলো "গম্ভীরা গান"। আনুমানিক ১২০০-১৫০০ শতাব্দীর পালযুগের সমসাময়িক 'গম্ভীরা' বলে মনে করা হয়। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ দিনপঞ্জীতে গম্ভীরার উল্লেখ পাওয়া যায়।

বর্তমানে মালদহ জেলার ইংরেজবাজার, চাঁচল, বামনগোলা, বাচামারি, আইহো, ভূতনি, হবিবপুর, গাজোয়াল, মধুঘাটসহ বিভিন্ন জায়গায় গম্ভীরার প্রচলন দেখা যায়। জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলায় প্রচলিত লোকসঙ্গীতের নাম 'গমিরা'। মনে করা হয় 'গমিরা' ও 'গম্ভীরা' একই।

'গম্ভীরা' বা 'গমিরা' উভয় শব্দের উৎপত্তি নিয়ে নানারকম মত প্রচলিত রয়েছে। অনেকে মনে করেন গামার কাঠ থেকে মুখোশ তৈরি হতো যা এই আঙ্গিকে ব্যবহার করা হয়। তাই নাম 'গম্ভীরা'। আবার অনেকে মনে করেন 'গম্ভীরা' শব্দটির উৎপত্তি গম্ভীর থেকে যার মূলে স্বয়ং গম্ভীর (শিব)।

আবার অনেকের মতে 'গম্ভীরা' শব্দের প্রকৃত অর্থ বিশেষ ভঙ্গিতে গঠিত প্রশস্তক্ষেত্র গৃহ বিশষ। বিভিন্ন গবেষক মনে করেন প্রাচীনকালে মালদহ অঞ্চলে বিশেষ ভঙ্গিতে গঠিত চণ্ডী মণ্ডপের গৃহ বা শিবালয় 'গম্ভীরা' বা 'গম্ভীরি' নামে পরিচিত হতো। শুধু মালদহ অঞ্চলেই যে চণ্ডী মণ্ডপের বা শিবালয় 'গম্ভীরা' নামে অভিহিত হতো তা নয়, রাঢ়ভূমি অঞ্চলেও কোথাও কোথাও শিবালয় গম্ভীরা নামে পরিচিত হতো। তবু কেন শিবোৎসব কেবলমাত্র মালদহ অঞ্চলেই 'গম্ভীরা' নামে পরিচিত পেল তা এখনও গবেষণার বিষয়।

তবে এ সম্পর্কে হরিদাস পালিত তাঁর 'আদ্যের গম্ভীরা' গ্রন্থে লিখেছেন "গম্ভীরা শব্দে যখন শিব মন্দির ও দেবালয় বুঝাইতেছে, তখন শিবাদির পূজা গম্ভীরাতেই হইত। শিবোৎসবাদি তথায় অনুষ্ঠিত হইত। এদেশের লোক গম্ভীরায় শিবের পূজা করিত। কালক্রমে উত্তর গম্ভীরায় শিবোৎসব গম্ভীরা পূজা নামে প্রচলিত হইয়া পড়িয়াছে"।

পশ্চিমবঙ্গের মালদহ অঞ্চলে চৈত্র-সংক্রান্তির গাজন উৎসবই গম্ভীরা নামে পরিচিত। চৈত্রের শেষ চারদিনে মূল অনুষ্ঠান হয়, তবে অঞ্চল অনুযায়ী বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য এমনকি শ্রাবণ মাসেও শিবমূর্তি স্থাপন করে গম্ভীরা পূজা হয়ে থাকে।

মালদহের নিম্নবর্ণের হিন্দু, কোচ-রাজবংশী, পোলিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা মূলত এই উৎসবে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। মালদহ জেলায় চারদিন ধরে এই উৎসব চলে। চতুর্থ দিনের উৎসবের নাম "তাহারা"। এই দিন মণ্ডপে শিবের সঙ্গে নীলপূজাও হয়। সেইসঙ্গে গম্ভীরা গান গাওয়া হয়। বিকেল বেলায় সঙ বেরোয়। গান গেয়ে অভিনয় করা হয়।

গম্ভীরা গানের শুরুতে দেবাদিদেব মহাদেবকে বন্দনা করা হয়। শিবরূপী মহাদেবকে মঞ্চে নিয়ে এসে তাঁকে সমস্ত বিষয় জানানো হয়। গম্ভীরা গান দু' ধরনের - আদ্যের গম্ভীরা এবং পালা গম্ভীরা। আদ্যের গম্ভীরায় দেব-দেবীর উদ্দেশ্য সুখ-দুঃখ পরিবেশন করা হয়। নানা-নাতি সেজে দুজন ব্যক্তি অভিনয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরে পালা গম্ভীরায়।

মালদহের গম্ভীরায় বিশেষত্ব হল মুখোশের ব্যবহার। স্থানীয় সূত্রধর সম্প্রদায় নিম এবং ডুমুর গাছের অংশ বিশেষের সাহায্যে মুখোশগুলো তৈরি করে। পেপার পাল্প বা কখনও কখনও মাটি দিয়েও মুখোশ তৈরি করা হয়। নরসিংহী, চামুণ্ডা কালি এছাড়া স্বর্ণকালি, বুড়ো-বুড়ি, পরি, রাম-রাবণ, কার্তিক, সরস্বতী, মুনি-ঋষি, গণেশ ইত্যাদির মুখোশ হয়ে থাকে। গম্ভীরা গানের তালে এই মুখোশ পরে নৃত্য করা হয়।

গম্ভীরার গান মৌখিক ধারার গান। সাধারণত গম্ভীরা গানের কোন লিখিত দলিল থাকে না। গম্ভীরার প্রায় সব গানই প্রতি বছর সাময়িক ঘটনাকে অবলম্বন করে রচনা করা হয়। এক বছরের গম্ভীরার আসর শেষ হয়ে গেলে পরের বছরে সেগুলির কোন মূল্য থাকে না।

গম্ভীরার প্রায় সব গানই শিব-বিষয়ক। শিবকে কেন্দ্র করেই গম্ভীরার গানগুলো তৈরি হয়। অন্তত প্রাচীন কালে এই রীতি প্রচলিত ছিল। সাম্প্রতিক কালে অন্যান্য বিষয়ক গানও পরিবেশিত হচ্ছে। গম্ভীরা গানের মূল রস হাস্য। কৌতুক, মস্করা ও তামাসার ভঙ্গিতে এ গান গাওয়া হয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...