"ভ্রমর কইও গিয়া
শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে
অঙ্গ যায় জ্বলিয়া রে
ভ্রমর কইও গিয়া"
এই লোকসঙ্গীতটি এখন বেশ চেনা গান। সবটাই 'ফোক ক্যাটাগরি' হলেও এই গান আসলে 'ধামাইল'। বাংলার লোকসঙ্গীতের ধারার প্রাচীন ঐতিহ্য। গানের কথায় 'গেঁয়ো' মানুষের সহজ আবেগের বলিষ্ঠ প্রকাশ।
সিলেটি ধামাইলের জনক হিসেবে পরিচিত রাধারমণ দত্ত গানটি লিখেছেন। বাংলাদেশের জগন্নাথপুর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৩৩ খ্রীস্টাব্দে। তিন হাজারের মতো সিলেটি ধামাইল গান তিনি রচনা করেছেন। তার মধ্যে এই গানটি খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এখন।
'ধামাইল' আসলে সঙ্গীতমুখর নৃত্য। সমাজের উচ্চ থেকে নিম্ন সমস্ত বর্ণের মধ্যে ধামাইল প্রচলিত ছিল। পরে নানা কারণে উচ্চ বর্ণে সেভাবে গাওয়া হত না। অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, বিবাহ ইত্যাদি সামাজিক উৎসব, গোপিনী কীর্তন, পুষ্পদোল, সূর্যব্রত ইত্যাদি ব্রত অনুষ্ঠান, নৌকাটান প্রভৃতি আচার পালিত হয় 'ধামাইল'-এর মাধ্যমে।
উৎসব, অনুষ্ঠান বা আচারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গানের বিষয়বস্তু ঠিক হয়। ব্রতর ক্ষেত্রে ভাগবতের কৃষ্ণলীলা কাহিনির লৌকিক রূপ ধামাইলের বিষয়। নৌকাটানার ক্ষেত্রে ধামাইল নাচের সঙ্গে বারমাসি গান হয়। বিবাহের মতো আনন্দ উৎসবে লৌকিক রাধাকৃষ্ণের কাহিনি, বিভিন্ন বিষয় স্থান পায়। সমসাময়িক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনাও ধামাইলে উঠে আসে।
সুরমা বরাক উপত্যকায় ধামাইল বিশেষভাবে পরিচিত। এছাড়া সিলেট, কাছাড় জেলা ও পূর্ব ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোণা মহকুমায় ধামাইল জনপ্রিয়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, সঞ্জয় মহাভারত, সতী ময়নামতী প্রভৃতি মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে 'ধামালি' বা 'ধামালী' শব্দটি পাওয়া যায়। যার অর্থ রঙ্গ-কৌতুক। সংস্কৃত শব্দ 'ধাবন' অর্থ দৌড়ানো বা দ্রুত পদক্ষেপ আর 'ধুমালী' হল কোন বিশেষ উৎসবে ভূমিকা হিসেবে বাজানো বাদ্যযন্ত্র। এই দুটি শব্দ থেকে 'ধামাইল' শব্দটি এসেছে বলে অনেকে মনে করেন।
ধামাইল মূলত মেয়েদের নাচ হলেও পুরুষরাও এতে অংশগ্রহণ করতে পারেন। সাধারণত সমবেতভাবে এই নৃত্য পরিবেশন করা হয়। এই নাচে পায়ের ভঙ্গিমা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। গানের তালে সামনে পিছনে পায়ের পদক্ষেপ পরিবর্তন করে গোল হয়ে ঘোরা হয়। যে পা পিছনের দিকে থাকে তার সামনের অংশ মাটি স্পর্শ করে আর গোড়ালি উপরে থাকে। এভাবে ডান এবং বাম পায়ের বদল ঘটিয়ে হাততালি দিয়ে নাচ করা হয়।
ধামাইল নৃত্য-গীতের নির্দিষ্ট কোন দিন নেই। মাসের পর মাস ধামাইল হচ্ছে এমন দৃশ্যও দেখা যায়। গ্রামে কোন একটি মেয়ের বিয়ে ঠিক হল। সেই বিয়েকে কেন্দ্র করে ধামাইল হতে পারে। কুমারী, সধবা-বিধবা সবাই এতে অংশ নিতে পারেন। সব শ্রেণীর মেয়েরাই এই অনুষ্ঠানে যোগ দেয়। উচ্চ-নীচ জাতিভেদ বা সামাজিক স্তরভেদ এতে নেই।
"শোকে নিশি গাইয়া যায়
ঐ বুঝি সজনী ডাকে দারুণ কুকিলায়।।"
বিয়ের সময় বাসর রাতের শেষে এই গান করা হয়। বিয়ের দিন ভোর রাতে নদীতে জল ভরার সময়ও গান করা হয়। এগুলি 'ভোর ধামাইল' নামে পরিচিত। ভোর ধামাইল সাধারণত ভোর রাতে গাওয়া হয়। গানগুলি যেহেতু ভোর রাতের গান, তাই এই গানের সুরে উচ্ছ্বাস কম থাকে। মিলন ও বিচ্ছেদের কথায় ভরপুর থাকে ভোর ধামাইল।
"জলে গিয়াছিলাম সই
কালা কাজলের পাখি
দেইখ্যা আইলাম কই।"
নদীর ঘাটে জল ভরতে যাওয়া এবং জল নিয়ে বাড়িতে ফিরে কলসি রেখে এই গান করা হয়। বাংলাদেশের সিলেট (শ্রীহট্ট) জেলায় অতি পরিচিত ছবি। একে জল ধামাইল বলা হয়। এই জল ভরা ধামাইলকে অনেকে বাঁশির গানও বলেন। ধামাইল গানের মূল বিষয় রাধাকৃষ্ণের বিচ্ছেদ। তাই বাঁশির প্রসঙ্গ চলে আসে।
বৈষ্ণব সাহিত্যের তত্ত্বকথার বদলে লৌকিক প্রেমের কথাই ধামাইলে বলা হয়। তাই বিচ্ছেদ-বেদনা এই গানে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। যে গ্রাম্য জীবনে মেয়েরা বিরহ-বেদনা-প্রেমের কথা প্রকাশ্যে উচ্চারণ করতে পারে না সেই কথা তারা ধামাইল গানের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করে।
"কইও কইও রে ভ্রমর
কৃষ্ণরে বুঝাইয়া
মুই রাধা মইরা যামুরে
কৃষ্ণ হারা হইয়া।"