বাংলার আঞ্চলিক লোকগীতিগুলিতে প্রধানত চারটি ধারা লক্ষ্য করা যায়। ভাটিয়ালি, বাউল, ঝুমুর এবং ভাওয়াইয়া। নদীমাতৃক বাংলাদেশের মূল লোকসঙ্গীতের সুর "ভাটিয়ালি"। ভাটিয়ালির সুরে সাধারণ মানুষ থেকে কৃষক, শ্রমজীবী ও মাঝি-মাল্লাররা তাদের সুখ-দুঃখ, প্রেম-ভালোবাসা প্রকাশ করেন।
ভাটিয়ালি গানে প্রকৃতি নিবিড় ও অন্তরঙ্গভাবে মিশে থাকে। আকাশ, নদী, বন, প্রান্তর ভাটিয়ালির সুরে একাত্ম হয়ে ওঠে। শুধু প্রেম নয়, আধ্যাত্মিকতাও গানের বিষয়। তবে তত্ত্বকথা ভাটিয়ালি গানে সেভাবে শোনা যায় না।
সুপ্রাচীন কাল থেকে ঊনিবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহ, ঢাকা, ফরিদপুরের লোককবির রচিত সুর যা "ভাটিয়ালি" নামে প্রচলিত, পরবর্তীকালে তার সঙ্গে লেখা ভাষা-বানান তথা উচ্চারণভঙ্গীর তারতম্য ঘটায় ভাটিয়ালিতে খাঁটি রূপ এখন প্রায় দেখা যায় না।
করুণ রসাত্মক সুরে একমাত্র বিচ্ছেদ লহর পরিবেশন করা হয়। সুর ধীর গতিতে গাওয়া হয়। গানের সঙ্গে শুধুমাত্র বেহালা ও সারিন্দা বাজানো হয়। একক কন্ঠেই এই লহর গাওয়া হয়ে থাকে।
বাইচ নৌকা বা হাটুরে ছিপ নৌকার হাত বৈঠা তাল রাখতে অথবা ছাদ পেটানোর সময় পিটুনির তাল রাখতে সারীলহর ব্যবহৃত হয়। সারীলহর কোরাসে গাওয়া হয়।
ঝাঁপলহরে সব রকম 'রস' ভালো জমলেও করুণরস সেভাবে জমে না। তাই করুণ রসাত্মক গানের গায়ক সাধারণত ঝাঁপলহরে গান গাইতে চান না।
ভাটিয়ালি সুরের প্রধান এই তিনটি লহর ছাড়া বাকি সব লহর ফেরুসাই লহর নামে পরিচিত। এই সমস্ত সুরে সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার স্রোতে ভাঙ্গা অসমতল ছন্দ বা পাহাড় ভাঙ্গা নদীর সুরের দোলন, অথবা খোলা প্রান্ত বা নিঝুম রাত্রির নিস্তরঙ্গ নদীর স্পন্দন অনুরণিত হয়।
ভাটিয়ালির গঠনেও রয়েছে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য। দু-তিনটি শব্দ নিয়ে একটি শব্দগুচ্ছ এক একবারে উচ্চারিত হয়। এই উচ্চারণের পরেই থাকে লম্বা টান। শব্দগুচ্ছের শেষ বর্ণটি যে স্বরে গিয়ে থামে সেটি দীর্ঘ হয়। এই স্বরের দীর্ঘ কতটুকু হবে তা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে গায়কের উপরে।
ভাটিয়ালি গান শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই তা সাধারণত চড়া সুরের দিকে চলে যায়। তারপর ধীরে ধীরে মন্দাক্রান্তালয়ে অথবা দ্রুত ছন্দে নেমে আসে। ভাটিয়ালিতে যন্ত্রানুষঙ্গ বড় একটা থাকে না। বৈঠার জল টানা শব্দ, নদীর ঢেউয়ের শব্দ অথবা বেহালা, বাঁশি বা সারিন্দাই ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
এ ভব সাগর রে ক্যামনে দিব পাড়ি রে।
দিবা নিশি কান্দিরে নদীর কুলে বইয়া
ও মন রে যার আছে রসিক নাইয়া
আগে তরী গেল বাইয়া রে।
আমি ঠেইকা রইলাম বালু চরে মাঝি-মাল্লা লইয়া রে।
ও মনরে ভব সাগরের ঢেউ দেখিয়া প্রাণ পাখি যায় উড়িয়ারে।
আমি হতভাগা পইড়া গো রইলাম ভাঙ্গাতরী
লইয়ারে।