রঙ্গে নাও রঙ্গে বৈঠা রঙ্গে রঙ্গে বাও।
পাতাম কন্ঠের বৈঠা আমার উড়ান দিয়া যাও।
রে উড়ান দিয়া যাও।
রঙ্গে রঙ্গে বাওরে বৈঠা রঙ্গের দোহার গাইয়া।
মধুবালার দেশে ডিঙ্গি শীঘ্র যাওরে বাইয়া।।
হেঁইয়ো জোয়ান হেঁইয়ো। আরো জোর হেঁইয়ো।।
সাবাস জোয়ান হেঁইয়ো। আগের নাও পাচ্ছে গেল
হেঁইয়ো জোয়ান হেঁইয়ো।।.....
'নৌকা বাইচের গান' বাংলাদেশের লোকসঙ্গীত হিসেবে পরিচিত একটি নাম। 'বাইচ' বা 'বাচ' বলতে বোঝায় খেলা বা প্রতিযোগিতা। নৌকা বাইচ হল বিশেষ ধরণের কতগুলি নৌকার খেলা বা দৌড় প্রতিযোগিতা।
নদীমাতৃক বাংলায় সেকালের মাঝি- মাল্লা বা নাবিকগণ রীতিমতো পাল্লা দিয়ে নৌকা চালাত। নৌকা বাইচের গান' বিনোদনের পাশাপাশি শরীর চর্চা ও শক্তি চর্চার মাধ্যম ছিল।
বাইচ শব্দটি ফার্সি 'বাজি' শব্দজাত। বিবর্তনের পথ ধরে বাজি শব্দ থেকে বাইজ হয়ে বাইচ হয়েছে। 'বাইচ' শব্দটির বুৎপত্তি বিবেচনা করে বোঝা যায় মধ্যযুগের মুসলমান নবাব, সুবেদার, ভূ-স্বামীরা যাদের নৌবাহিনী ছিল, তাঁরা এই প্রতিযোগিতামূলক বিনোদনের সূত্রপাত করেছিলেন।
নৌকা বাইচের ইতিহাস সন্ধান করলে নানাধরণের মতামত উঠে আসে। জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রাকে কেন্দ্র করে নৌকা বাইচের সৃষ্টি বলে অনেকে মনে করেন। স্নানযাত্রার সময় স্নানার্থীদের নিয়ে মাঝি-মোল্লাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হত। সেখান থেকে কালক্রমে নৌকা বাইচের শুরু।
মুসলিম যুগের নবাব-বাদশাহের আমলে নৌকা বাইচ বেশ জনপ্রিয় ছিল। নবাব বাদশাহের নৌ-বাহিনি থেকে নৌকা বাইচ শুরু হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। পূর্ব বঙ্গের ভাটি অঞ্চলের রাজ্য জয় ও রাজ্য রক্ষার অন্যতম কৌশল ছিল নৌশক্তি। বাংলার বার ভুঁইয়ারা নৌ শক্তি দিয়ে মোগলদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। মগ ও জলদস্যুদের দমনে নৌশক্তি কার্যকর ভূমিকা নেয়।
বাইচ নৌকাকে চলতি ভাষায় 'বাচারী-নৌকা' বলে।
বাচারী-নৌকা লম্বায় সুবৃহৎ 'সালতি' বা 'ছিপ' গোছের। ৫০ থেকে ১০০ হাত লম্বা হয়ে থাকে। সেগুন কাঠের নৌকা দ্রুতগামী। এক একটি নৌকায় একসঙ্গে ৮০/৯০ জন বৈঠা বাইতে পারে। প্রকৃত বাইচের নৌকার বিশেষত্ব হল, এর গৌলুই লম্বা হয় ১৫/২০ হাত। এই নৌকায় কোনরকম মাল বহন করা হয় না। জেলে বাচারী নৌকাগুলি লম্বায় স্বল্প হয়, গলুইও দীর্ঘ হয় না। এর সামনের দিকে প্রয়োজনে মাল বহন করার জন্য কিঞ্চিৎ ফাঁকা রাখা হয়।
নৌকার দুইদিকে হাতে বৈঠা নিয়ে মাঝি-মাল্লাগণ বসেন। নৌকার মাঝখানে, গলুইতে এবং পিছনের দিকে মোড়ল বা মালিক শ্রেণীর পাঁচ-সাত জন দাঁড়িয়ে থাকেন। এঁরা টিকরা ও কাঁসরের-ঝাঁঝরের বাজনার তালে-তালে নাচতে থাকেন। এই বাজনার তালে-তালেই নৌকা এগিয়ে চলে। একে 'তাল' না বলে 'ঝুল' বলে মাঝিরা। কেউ তার বা ঝুল হারিয়ে ফেললে আঘাত প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকে।
নিজস্ব বার্তা বা দলের প্রয়োজনে সাড়া দেবার দরকার পড়লে তালে তাল রেখেই প্রয়োজন মেটাতে হয়। দৌঁড় প্রতিযোগী নিদির্ষ্ট সীমানা অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে মাঝি-মাল্লা একই সঙ্গে বৈঠা তুলে ধরেন এবং শাঁখ-ঝাঁঝ বাজতে থাকে। বড়ো বাচারীতে দুই জন করে মাঝি হাল বৈঠা ধরেন। নৌকায় বিভিন্ন রঙের অলংকার ও কারুকাজ করা থাকে। বিশ্বকর্মা পূজা, কালী পূজা, মনসা পূজা, দুর্গা পূজা প্রভৃতি উপলক্ষে বাইচের প্রতিযোগিতা হয়।
বাইচ-প্রতিযোগিতা হয় লম্বা খাল অথবা নদীবক্ষে। বাইচ-বিজয়ীকে পিতলের কলসি, শিল্ড প্রভৃতি উপহার দেওয়া হয়। প্রতিযোগিতার সময় নানারকম গান করেন। এই গানগুলো সারি পর্যায়ের হলেও ব্রজলীলা সম্বন্ধীয় গানই বেশি গাওয়া হয়ে থাকে।
বাইচের নৌকা যখন মালিকের ঘাট থেকে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রের দিকে রওনা হয় তখন গ্রামের বৌরা কাঁসরের তালে তালে গান গেয়ে বরণ করে। গ্রামীণ ভাষায় প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রকে বলা হয় 'আড়ঙ'। আড়ঙ থেকে ফিরে আসবার সময়ও গান আছে। বাচ-খেলায় পরাজিত হলে সেক্ষেত্রেও করুণ রসাত্মক গান করা হয়। আড়ঙ থেকে জয়লাভ করে ফিরে এলে বড়োদের প্রণাম করার পাশাপাশি ধুমধাম করে বিজয়োৎসব পালন করা হয়।