বাঁকুড়া থেকে ঝাড়গ্রাম যাওয়ার পথে সবুজঘেরা জায়গা। তার মাঝে পাতাঘেরা একটি অঞ্চল। এখানেই মা দুলালীর থান। বাঁকুড়া থেকে ঝাড়গ্রাম যাওয়ার মাঝেই পড়ে এই বিশেষ জায়গা। মটগোদা। আগে নাকি জায়গাটার নাম ছিল মঠগোদা। লোক মুখে নাম পরিবর্তিত হতে হতে অপভ্রংশ হয়ে জায়গাটির নাম পরিবর্তিত হয়েছে। অঞ্চলটি মূলত বিখ্যাত শ্মশানঘাট অংশের জন্য। এই শ্মশানঘাট থেকে কিছুটা এগিয়ে বাঁদিকে গিয়ে একটা রাস্তা ঢাল বেয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে। তার পাশেই রয়েছে একটি ঝিল। এছাড়াও রয়েছে ধানক্ষেত। জায়গাটা সবুজ ঘেরা, মেঠো। ঝোপঝাড় আর শুকনো পাতাঘেরা অঞ্চলটা ভেতরেই রয়েছে মা দুলালীর থান। থান বলতে এখন তো সিঁদুরলেপা পাথরের খন্ড আর স্তুপ করা পোড়া মাটি হাতি ঘোড়ার মূর্তি।
ঝাড়গ্রাম অঞ্চলের ভীষণ জাগ্রত একজন দেবী মা দুলালী। এই দেবীর পুজো শুরু করেছিলেন বিদু সর্দার। বিদু সর্দার শ্মশানঘাটে থাকতেন। লোকেরা তাকে বিদু বুড়ো নামে ডাকতো। এই শ্মশানঘাটে বিদু সর্দারের প্রধান সঙ্গী ছিলেন মা দুলালী। বিদু সর্দার মা দুলালীর পুজো শুরু করেছিলেন শ্মশান ঘাটে। পরবর্তীকালে তিনি যখন শ্মশানঘাট ছেড়ে মঠগোদার একটি অঞ্চলে বসবাস করতে যান সেখানে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তার প্রিয় মা দুলালীকে। মূলত সর্দার সম্প্রদায়ের লোকেরাই এই পুজো করার অধিকার পায়।
বিদু বুড়ো মায়ের পুজো শেষ করার পর শেষ বয়সে তিনি পুজোর দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন মঠগোদা গ্রামের পঞ্চানন সর্দারকে। পঞ্চানন সর্দারের পরিবার বংশপরম্পরায় এই ঠাকুরের পূজো করে আসছেন। পঞ্চানন সর্দারের পর পুজোর দায়িত্ব পেয়েছিলেন ওঁর বড় ছেলে হাঁদু সর্দার। তারপর এই পুজোর দায়িত্ব পান অজিত সর্দার। আপাতত এই সর্দার বংশের উত্তরসূরী হাড়িরাম সর্দারকে পুজোর সমস্ত নিয়ম নীতি পালন করতে হয়। সর্দার পরিবারের ছেলেরা এভাবেই বংশপরম্পরায় মা দুলালীর পুজো করে আসছে।
কথিত আছে একমাত্র সর্দার পরিবারের বড় ছেলেই এই পুজোর দায়িত্ব পায়। কোন কারণে বড় ছেলে পুজোর দায়িত্ব নিতে অক্ষম হলে সেক্ষেত্রে বাড়ির ছোট ছেলে পুজোর দায়িত্ব পায়। এছাড়া বাড়ির আর কেউ পুজো করার অধিকার পায় না।
পয়লা মাঘ মা দুলালীর পুজো করা হয়। বছরে এই দিনটি বাদেও আশ্বিন মাস এবং চৈত্র মাসেও মা দুলালীর পুজো করা হয়। স্থানীয় লোকেরা নিজেদের নানা মনস্কামনা মা দুলালীর কাছে এসে মানত করেন। শোনা যায় কিছুদিন আগে একজন নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবারের মানুষ মা দুলালীর কাছে তার আত্মীয়ের ফিরে আসার মানত করেছিলেন। মানত করার কিছুদিনের মধ্যেই নাকি ওই ব্যক্তি বাড়ি ফিরে আসেন।
এই অঞ্চলের স্থানীয় মানুষরা মা দুলালীকে বিশ্বাস করে, ভক্তি করে। মা দুলালীর কাছে মানত করলে ঠাকুরের জন্য ডালা ভর্তি করে শীতল দেয়। শীতল অর্থাৎ ফলমূল, মিষ্টি, চিঁড়ে, মুরগি, ধুপ, সিঁদুর ঠাকুরের জন্য দান করেন। স্থানীয় ভাষায় একে শীতল দেওয়া বলে। এছাড়া পোড়া মাটির হাতি ঘোড়ার ছলন মূর্তিও মায়ের উদ্দেশে দান করা হয়। এই ছলন মূর্তিগুলোকেই মা দুলালীর বাহন হিসেবে মানা হয়। মানত করে দান করা চলন মূর্তিতে স্তুপাকার রয়েছে মা দুলালীর থান।
পয়লা মাঘ মা দুলালির পুজো করা হয় বছরে এছাড়াও আশ্বিন মাস এবং চরিত্র মাসেও মা দুলালীর পুজো হয়। পুজোর উপকরণ বলতে ফল, সেদ্ধ চাল, আতপ চাল, বিল্লি কলাই, লাহের কলাই, মুসুর ডাল, মুগ ডাল, তুলসীপাতা, বেলপাতা এবং পোড়া মাটির হাতি, ঘোড়া পুজো হিসেবে দেওয়া হয়। পূজোর কোন মন্ত্র নেই। শুদ্ধ মনে উপোস থেকে পুজোয় বসেন পুরোহিত। পুরোহিত মা দুলালীর প্রতিকী পাথর খণ্ডটিকে গঙ্গা জল দিয়ে স্নান করিয়ে তাতে সিঁদুর লেপে তিলক কেটে দেন। তারপর উপকরণ সাজিয়ে দেন মায়ের সামনে। এই পুজোয় বলি প্রথা রয়েছে। বলি বলতে ঠাকুরের উদ্দেশে পাঁঠা বলি এবং মুরগি ও পায়রা বলি প্রথাও রয়েছে। বলির মাংস এবং রক্ত থালায় করে ঠাকুরের সামনে উৎসর্গ করা হয়। বাকিটা মাংস রান্না করে প্রসাদ হিসেবে ভক্তদের দেওয়া হয়। এছাড়াও খিচুড়ি দেওয়া হয় ঠাকুরের সামনে। পুজোয় বসলে পূজারী অজিত সরদারের ভর আসে। মা দুলালী এমনই জাগ্রত যে তার থানের আশেপাশে কেউ কিছু চুরি করতে পারে না। শোনা যায় কেউ চুরির উদ্দেশ্যে এলেই তাকে নাকি সাপে কামড়ায়। সর্দার সম্প্রদায়ের কাছে নিজের মায়ের মতই আপনজন এই দুলালী মা। তাই সর্দার সম্প্রদায়ের মানুষ ভক্তির সঙ্গে সাড়ম্বরে দুলালী মায়ের পুজো করেন।