দক্ষিণা কালীর এক রূপ বুড়িমাই দেবী

দুর্গাপূজার নবমীর দিন সকাল বেলা থেকে সাজো সাজো রব পড়ে দেবী ষড়চক্রবাসিনী বেরিয়ে আসবেন রাজ অন্তঃপুরের মন্দির থেকে। মাঠ উপচে রাস্তায় রাস্তায় মানুষের ঢল উপচে পড়ে। দক্ষিণ বাঁকুড়ার জঙ্গলঘেরা শ্যামসুন্দরপুর গ্রামের রাজ পরিবারের অধিষ্ঠাত্রী কুলদেবী হলেন ষড়চক্রবাসিনী। তিনি দক্ষিণা কালীর এক রূপ। গ্রামবাসীরা দেবীকে ভালোবেসে বুড়িমাই বলে ডাকে। বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজাদের দেবী মহামারী যেমন তাঁর ভীষণ উগ্র রূপের সাথে সাথে জাগ্রত রূপে বিরাজিত। ঠিক সেভাবেই বিষ্ণুপুর রাজবাড়ীর সাথেই সম্পর্কিত শ্যামসুন্দর পুর রাজবাড়ীর ষড়চক্রবাসিনী দেবীর নামমাহত্ম্যের কথা সর্বজনবিদিত। শ্যামসুন্দরপুর পরগনার ক্ষত্রিয় রাজবংশের প্রাচীন রাজবাড়ী ঐতিহ্যবাহী সাড়ে পাঁচশো বছরের ইতিহাস। সেই ইতিহাসের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে এই মল্ল রাজবংশের রাজকুলদেবী শ্রীমদ দক্ষিণা কালী ষড়চক্রবাসিনীর কথা।

বহুদিন আগের কথা, তখন শ্রীক্ষেত্র পুরীর পরাক্রমশালী রাজা মুকুন্দদেবের রাজত্বকাল। আনুমানিক বাংলা ৮৭২ বঙ্গাব্দ ইংরেজী ১৪৬৫ খ্রিস্টাব্দ। সেই সময় হিন্দু ধর্মচ্যুত যবন রাজ কালাপাহাড় হিন্দু দেবদেবীর মন্দিরের উপর তান্ডব শুরু করেছিলেন, পুরীর জগন্নাথ জীউ মূর্তি ও মন্দির আক্রমণ করলে রাজা মুকুন্দদেব তার দুর্ধষ রণকৌশল দিয়ে কালাপাহাড়কে আক্রমণ করেন। তাঁর দুই ছেলে নকুড় ও ছকুড় দেব তাঁকে যুদ্ধে সর্বতোভাবে সাহায্য করেছিলেন। দুই ছেলের পরাক্রমের সামনে কালাপাহাড় দিশেহারা  হয়ে পড়ে। তাঁর সৈন্যদের বিপর্যয় দেখে তিনি গভীর জঙ্গলে পালিয়ে যান ও সেখানে গিয়ে ঈশ্বর সাধনায় জীবন উৎসর্গ করেন। অন্যদিকে নকুড় নারায়ণ তুঙ্গ দেও ওরফে রাজা ছত্র নারায়ণ তুঙ্গ দেও শ্রীক্ষেত্র পুরী রাজদরবার থেকে গড় শ্যামসুন্দুরপুর গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন ও রাজত্ব কায়েম করেন। সেই কারণে এই গড়কে তুঙ্গভূম বলা হয়ে থাকে। যদিও তাঁর দক্ষিণ বাঁকুড়ার এই স্থানে আসার কারণ নিয়ে মতানৈক্য আছে। তিনি ওখান থেকে আসবার সময় পুরীর রাজবাড়ীর মন্দির থেকে অনেক দেব দেবী নিয়ে আসেন তার মধ্যে কুলদেবী ষড়চক্রবাসিনী বা রাজকুল লক্ষী দেবী অন্যতম। ইঁহার ছয়টি হাত, এক এক হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম এবং দুই হাতে হস্তী ধারণ পূর্বক ষড়চক্রবাসিনী দেবী বিরাজমান। মূলতঃ তিনি শক্তির আধার রূপে পূজিত হন। ক্ষত্রিয় রাজারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে শক্তির উপাসনা করেছেন, এটিও তার নিদর্শন।  তিনি এলাকার মানুষের কাছে মনস্কামনা পূরণের চাবিকাঠি, তাই তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য ছাগবলির প্রথাও চালু আছে। দেবী সর্বদা রাজঅন্তঃপুরে ঠাকুরঘরে পূজিত হন, তবে বিশেষ দিনে সর্বসমক্ষে বের হন। সারা বছরে দেবী ষড়চক্রবাসিনী তিনদিন বের হন। রাজবাড়ীর সম্মুখে তাঁর নির্দিষ্ট মঞ্চে নবমী দিন তিনি পূজিত হনও এই দুর্গা পূজার সময় বিরাট মেলা বসে, ভক্তদের মনস্কাম পূর্ণ হওয়ার পিপাসায় এখনও প্রায় শতাধিক ছাগ বলি হয়।

বিজয়ার দিন বিকেল প্রায় ৪টের সময় পাটাবিন্দা (রাবনবধ) উপলক্ষ্যে রাজবাড়ীর মন্দির থেকে রাজপুরোহিতের কোলে চেপে দেবী রওনা হন প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে ঝেঁঞ্জা গ্রামের শেষ প্রান্তে জঙ্গল ঘেরা তাঁর নির্দিষ্ট জায়গায়। সেইখানে পুজোপাট ও হোম হয় তারপর আবার সেখান থেকে এক দৌড়ে দেবী ষড়চক্রবাসিনী পুরোহিতের কোলে চেপে রাজবাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করেন। যাওয়া আসার এই পথে পুরোহিতের সঙ্গী হিসেবে দেবীর মাথার উপর ছাতা ধরার জন্য একজন ছত্রধর থাকেন। দুজনেই এক দৌড়ে ছুটে যান ও ফিরে আসেন। কথিত আছে এই সময় কোন এক আধ্যাত্মিক মহিমাবলে দুজনেই এত জোরে দৌড়ান যে কোনো দৌড়বীর তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেন না। এখনও এই প্রথার প্রচলন রয়েছে, আজও দেবী বেরোনোর সময় সারা রাস্তার দুপাশে অগণিত মানুষজন ভীড় করে এই দৌড় দেখবার লোভে। শোনা যায় দেবী ষড়চক্রবাসিনী দুর্গার আর এক রূপ হয়ে পুজো পাবার ইচ্ছে প্রকাশ করেন ও জঙ্গল ঘেরা গ্রামে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যেও তিনি তাঁর কৃপা প্রদর্শনের উদ্যেশ্যে নির্দিষ্ট দিনে হাজির হন। সবাই কে একসাথে নিয়ে চলার বার্তায় দেবী ষড়চক্রবাসিনী তথা গ্রামের মানুষের বুড়িমাই এক নজির রেখে গেছেন। যা আজও গ্রামের মানুষেরা গভীর ভাবে মেনে চলে। বুড়িমাই সম্পর্কে ওপার বাংলায় এক প্রচলিত ছড়া চালু আছে-

"শীত করে গো বুড়িমাই, কাথার তলে জেগা নাই, কাথা নিলো শিয়ালে, আনিয়া দিবো বিয়ালে।"

 যদিও দুই দেবীর নামে মিল থাকলেও দুজনেই একই নন। তবু ভারতবর্ষ কেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বুড়িমাই নামে দেবী, মানুষ, সম্প্রদায়ের দেখা মিলছে। তবে শ্যামসুন্দর পুরের বুড়িমাই দেবী ভীষণ ভাবেই জাগ্রত, তার কীর্তি কাহিনীর কথা এলাকা জুড়ে বিশেষভাবেই পরিচিত।

অমাবস্যা তিথিতে শ্যমাপুজোর দিন কালী রূপে পূজিত হওয়ার জন্য গভীর রাত্রে বলি প্রদানের মধ্য দিয়ে তাঁর পূজার্চনা করা হয়, দেবীর নির্দিষ্ট মঞ্চে আবির্ভাব ঘটে। এলাকায় তিনি জাগ্রত কালী রূপে থাকার জন্য এই মৌজায় কোনোরূপ কালী পুজো করা নিষিদ্ধ, এমনকি দু একজন জোর করে কালী মূর্তি করে পুজো করতে গেলে তাদের নানারূপ বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে বলে শোনা যায়। সেই কারণে আর কেও এরূপ চেষ্টা করে না।

বছরে এই তিনদিন ছাড়াও যদি কোনও বছরে গ্রামে বসন্ত বা কলেরার মতো সংক্রমিত রোগ দেখা যায় তাহলে গ্রামের লোকেরা মায়ের কাছে প্রার্থনা করলে মা'কে পুজো করার জন্য নির্দিষ্ট মঞ্চে নামানো হয়। শোনা যায় তাঁর এমনই মহিমা যে  পুজোপাট শেষ হবার ক’দিনের মধ্যেই গ্রাম থেকে মহামারী চলে যায়।

                    

                    

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...