ব্যালকনি বা ছাদবাগানের ফুল চাষে জৈব সার তৈরি ও প্রয়োগ পদ্ধতি

সার হল গাছের খাবার। মাটির গাছ স্বাবলম্বী, সে নিজের খাবার নিজেই জুটিয়ে নিতে পারে। কিন্তু টবের গাছ তো আর সেটা পারে না। তাকে আমরা টবের কয়েদখানায় বেঁধে ফেলেছি। কয়েদিদের যেমন নিয়মিত খাবার দিতে হয়, তাকেও সেভাবেই দিতে হয়। কেননা, টবের চৌহদ্দিতে তার জন্য যেটুকু মাটি আমরা নির্দিষ্ট করেছি, সেটুকুতে যা খাবারদাবার থাকে, তাতে তার বেশিদিন ভালোভাবে চলে না। বাইরে থেকে খাবার না-দিলে তার অপুষ্টিসহ নানান রোগের লক্ষণ দেখা দেয়।

আমরা সবাই জানি যে, সার দু’রকমেরঃ জৈব ও রাসায়নিক। জৈব সার দিয়ে মানুষ সেই কৃষির প্রথম পর্ব থেকেই চাষ করে আসছে। আমাদের ছাদ বা ব্যালকনিবাগানেও আমরা তাকে সফলভাবে প্রয়োগ করব। কীভাবে বলছিঃ

কিছু জৈব সার আমরা বাড়িতেই তৈরি করব। কিছু বাজার থেকে কিনতে হবে। বাড়িতে তৈরির জন্য আমাদের প্রথমে যেতে হবে দশকর্মার দোকানে। ওখান থেকে মাটির ভাঁড় কিনতে হবে দুটো। ভাঁড়গুলোতে যেন দেড় থেকে দু’লিটার জল ধরে এমন মাপ বুঝে কিনতে হবে। দুটোর ভাঁড়ের জন্য দুটো মাটির সরা কিনতে হবে। সরাগুলো দুটো ভাঁড়ের মুখেই ঢাকনার মতো যাতে চেপে বসে, এটা দেখে নিতে হবে।

এই যে দুটো ভাঁড় কেনা হল, এর একটা ব্যবহৃত হবে সরষের খোল ভিজিয়ে সার বানানোর জন্য; অন্যটাতে বাড়ির যাবতীয় সবজি ইত্যাদি পচিয়ে সার বানানোর জন্য। আসলে, মাটি ছাড়াও যে-কোন ঢাকনাযুক্ত পাত্রেই এই সার দুটো তৈরি করা যায়, কিন্তু মাটির পাত্রে তৈরি সারে প্লাস্টিকের ক্ষতিকর পদার্থ মেশে না, ধাতুর পাত্রের মতো ধাতুগত কোন বিক্রিয়া হয় না, সূক্ষ্মভাবে হাওয়া চলাচল হয় বলে পচনক্রিয়া সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়, এবং যে বৈজ্ঞানিক কারণে কলসির জল ঠাণ্ডা থাকে, সেই একই কারণে মাটির পাত্রে তৈরি সারও ঠাণ্ডা থাকে। এসব কারণেই আমি জৈব সার তৈরির জন্য মাটির ঢাকনাযুক্ত ভাঁড়ই পছন্দ করি।

প্রথম ভাঁড়। পাকা কলা, ফল, পেঁয়াজ, রসুন, সবজির খোসা এই ভাঁড়ে ফেলবেন। সেদ্ধ বা কাঁচা ডিমের খোলা কাজের জিনিস। এতে প্রচুর ক্যালসিয়াম রয়েছে। হাতে চাপ দিলেই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাবে। এগুলো এই ভাঁড়ে ফেলবেন। চা ছেঁকে নেওয়ার পর চায়ের পাতা এই ভাঁড়ে ফেলবেন। চাইলে এতে একশ গ্রাম গুড় দিতে পারেন। এসবে ভাঁড়ের অর্ধেক ভর্তি হয়ে গেলে, সেগুলো ইঞ্চি দুয়েক ডুবে থাকে এমন পরিমাণ জল দিয়ে মুখে ঢাকনা বসিয়ে সটান ছাদ বা ব্যালকনির কোনায় রেখে দিন পনেরো দিনের জন্য। দিনতিনেক পর পর একবার করে শুধু ঢাকনা খুলে একটা কাঠি দিয়ে ঘেঁটে দেবেন। যত দিন যাবে ঢাকনা খুললেই নাকে বেশ গন্ধ লাগবে। চাইলে মাস্ক পরে নিতে পারেন।

যাই হোক, পনেরো দিন পর দেখা যাবে যে, ভাঁড়ের ভেতরের সমস্তটা পচে বেশ থিকথিকে হয়ে গেছে। এবার নাইলনের মশারির টুকরো, পুরনো ফাঁকা ফাঁকা করে বোনা গামছা কিংবা ছোট্ট চালুনিতে এই থিকথিকে জিনিসটা নিয়ে বেশ ডলে ডলে তা থেকে জলটা বের করে নিতে হবে। ডলার পর হাতের দুর্গন্ধ সহজে যায় না, তাই এ-কাজের জন্য সার্জিকাল গ্লাভস ব্যবহার করতে পারেন। যাই হোক, এভাবে জল বের করে নেবার পর যে শক্ত মণ্ডটা পড়ে থাকবে, সেটা ফেলে দেবেন না, শুকিয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো করে তুলে রাখবেন, সার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। যাই হোক, এগুলো ছেঁকে যে তরলটা পাওয়া গেল, সেটা একটা বোতলে ঢেলে রাখুন, প্রয়োজনমতো ব্যবহারের জন্য। এবার ব্যবহার কীভাবে করবেন, সেটাই বলি। ধরুন, এক মগ এই তরলটা নিলেন, তো তার সঙ্গে ছ’মগ সাধারণ জল মিশিয়ে পাতলা করবেন। আধ মগ নিলে, তিন মগ জল। অনুপাতটা এ-রকম। জলের সঙ্গে মেশানোর পর এই তরল সার সব ধরণের গাছেই দেওয়া যায়। এতে রয়েছে গাছের প্রয়োজনীয় অনেক রকমের খাবার। এই খাবার খেয়ে গাছ সতেজ, সবুজ ও সপুষ্ট থাকে।

এবার দ্বিতীয় ভাঁড়। এক মুঠো সরষের খোল এতে ভেজাবেন এক লিটার জল দিয়ে। তারপর মুখে ঢাকনা দিয়ে দেবেন। খুলবেন তিন দিন পর। তিন দিন এভাবে পচানোর পর প্রথম ভাঁড়ের সবজির খোসা ইত্যাদি যেভাবে ছেঁকে তা থেকে জলটা বের করে নিয়েছিলেন, সেভাবেই এটার থেকেও জল বের করে মণ্ডটা আলাদা করে শুকিয়ে পরে ব্যবহারের জন্য রেখে দেবেন। এবার খোল পচানো জল গাছে দেবার আগে সেটা আগের মতোই পাতলা করে নিতে হবে। এতে এক মগ খোলপচা জল নিলে, তার সঙ্গে মেশাতে হবে দশ মগ সাধারণ জল। আধ মগে, পাঁচ মগ সাধারণ জল এই অনুপাতে। এই তরলসারও সব ধরণের গাছে দেওয়া যায়। এই সারে উপস্থিত নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম ও বিভিন্ন ধরণের অনুখাদ্য গাছকে সতেজ ও সপুষ্টভাবে বাড়তে সাহায্য করে। বাজারে বিশুদ্ধ সরষের খোল ছাড়াও বাদাম, সরষে প্রভৃতি মিশিত পেন্সিল আকৃতির এক ধরণের খোল পাওয়া যায়, এটাও খুব ভালো। এই খোলও এভাবে ব্যবহার করা যায়। 

এই দু’ধরণের তরল সারই বর্ষাকালে টানা বৃষ্টি হচ্ছে, এমন সিচুয়েশনে দেওয়া যাবে না। পরিবেশ শুকনো হলে এবং টবের মাটি একেবারে খটখটে নয়, খুবই সামান্য ভেজা আছে এমন অবস্থায় প্রয়োগ করবেন। জৈবসারের খুব একটা ক্ষতিকর দিক নেই, তাই বলে প্রচুর পরিমাণে এই তরল সার দিতেই থাকবেন—এটাও কাজের কথা নয়। মাত্রাতিরিক্ত খাবার মানুষ বা গাছ কারোর জন্যই ভালো নয়। তা যা দেবেন, মাত্রায় দেবেন। বর্ষাকালে টানাবৃষ্টির সময় এই সার দিলে মাটিতে ক্ষতিকর ছত্রাক হবে, পোকা হবে এবং সবমিলিয়ে গাছের ক্ষতি হবে। তাই এই সময়টায় গ্যাপ রেখে পরিবেশ খানিক শুকনো শুকনো হলে, তখন দেবেন। আর খোল তিন দিনের বেশি পচাবেন না বা পচানো জল জমিয়ে রাখবেন না—সে-সব উল্টে গাছের ক্ষতিই করে।

বাড়িতে তরল সার ছাড়াও আপনি সহজেই কম্পোস্ট সার তৈরি করে নিতে পারবেন। সেটা আপনি কিছুটা এই তরল সার তৈরি করতে গিয়েও পাচ্ছেন। ওই যে বললাম, সবজির খোসা পচা জল বের করতে গিয়ে যে মণ্ডটা ও খোলপচা জল ছেঁকে যে মণ্ডটা রোদে শুকিয়ে গুঁড়ো করে তুলে রাখতে বললাম, ওগুলোও এক ধরণের কম্পোস্ট সার। গাছকে সতেজ ও পুষ্ট রাখার জন্য মাঝে মাঝে এই সার প্রয়োগ করবেন। খোসাপচা তরলসার তৈরির জন্য পনের দিন যখন সেগুলো পচছে, তখন তো নিত্যদিনের সব্জির খোসা, ডিমের খোলা ইত্যাদি আরও আরও জমছে, সেগুলো দিয়েই জমিয়ে কম্পোস্ট সার তৈরি করুন। একটা ঢাকনাযুক্ত ডাব্বায় সেগুলো প্রতিদিন জমাতে থাকুন। জল দেবেন না। ভর্তি হয়ে গেলে আর নতুন কিছু দেবেন না। তখন ঢাকনা খুলে সপ্তাহে একবার কেবল ঘেঁটে দেবেন, ওপর-নীচে উল্টে-পাল্টে দেবেন কাঠি দিয়ে। এভাবে মাস তিন রাখলেই সব পচে যাবে। এই পচানোর বিষয়টা দিন পনেরোর মধ্যে সেরে ফেলতে চাইলে নার্সারি-দোকানে বা অনলাইনে ‘ওয়াস্ট ডিকম্পোজার’ নামের এক ধরণের যৌগ কিনতে পাওয়া যায়। সেটা এক-দু’চামচ মিশিয়ে দিলেই কেল্লাফতে। এটা এসব বর্জ্যকে তাড়াতাড়ি পচিয়ে দেয় এবং এটা নিজে একধরণের অণুখাদ্য। সেই গুণ নিয়েই পচা বস্তুটির মধ্যে অবস্থান করে।

ডাব্বার পচে যাওয়া জিনিসটা এবার রোদে শুকনো করুন। শুকনো শুকনো হয়ে এলে গুঁড়ো করে তুলে রাখুন। মাঝে মাঝে রোদে দেবেন। মাসে দু’বার গাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করবেন। এই খাবারটি খুব কাজের। শুধুমাত্র বিভিন্ন গাছের পাতা ডাব্বায় ভরে বাড়িতে ওই একই পদ্ধতিতে ডিকম্পোজার দিয়ে পাতাপচা সার তৈরি করে নেওয়া যায় এক থেকে দেড় মাসের মধ্যেই। নইলে ছ’মাস থেকে এক বছর সময় লাগে। কম্পোস্ট সার এভাবে তৈরি যদি করাটা হ্যাপা মনে হয়, তাহলেও সমস্যা নেই, এটা বাজারে কিনতে পাওয়া যায়।

দেখুন, গাছের জন্য রাসায়নিক সারের ভাণ্ডারে সব রকমের সার আছে, প্রকৃতির মধ্যেও আছে। তাই জৈব পদ্ধতিতে টবের গাছকে সে-সমস্ত সঠিক পরিমাণে জোগান দেওয়া একটু হ্যাপার হলেও অসম্ভব নয়। গাছে নাইট্রোজেনের অভাব হলে আগের তরল সারগুলো যেমন দেবেন, তেমনি তার সঙ্গে সপ্তাহে একবার চায়ের পাতা ব্যবহারের পর তা ধুয়ে শুকিয়ে গুঁড়ো করে গাছের গোড়ায় দেবেন। ক্যালসিয়ামের অভাব হলে ডিমের খোলা গুঁড়ো করে গাছের গোড়ায় দেবেন। গাছে ফসফেটের অভাব হলে হাড়গুঁড়ো দেবেন। বাজারে সারের দোকানে বা নার্সারিতে কিনতে পাবেন। তিন রকমের হাড়গুঁড়ো পাওয়া যায়। মাঝারি ও ছোট দানা এবং একদম ডাস্ট। এই ডাস্টই আপনি কিনবেন। কেননা, এটা সহজেই মাটির সঙ্গে মেশে। মাটির সঙ্গে না-মিশলে তো আর কাজ হয় না। এছাড়াও সিং-কুচি নাইট্রোজেনের ভালো সোর্স। এটাও আপনি নার্সারিতে পেয়ে যাবেন। জৈব চাষে হাতের কাছে একটা জিনিস রাখবেন, সেটা হল নিমখোল। এই খোল মাঝে মাঝে ছত্রাকনাশক হিসেবে প্রয়োগ করবেন। তাছাড়া এটি যেমন মাটির উর্বরতা বজায় রাখে; তেমনি এতে আছে পটাসিয়াম, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, সালফার, কার্বন, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম প্রভৃতি—যা একটি গাছের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই জরুরী। মাসে একবার গাছে অনুখাদ্য স্প্রে করবেন, তাতে গাছপালা আরও সুন্দর থাকবে, সতেজ থাকবে। জৈব অনুখাদ্য যেকোন নার্সারি বা সারের দোকানে পাওয়া যায়। এক লিটার জলে সামান্য মেশালেই হবে।

রাসায়নিক সার মাটিকে খুব রুক্ষ্ম করে দেয়। এই সারের অত্যধিক প্রয়োগ গাছের স্বাভাবিকতাকে অনেক ক্ষেত্রেই নষ্ট করে। জৈব সার কিন্তু মাটির মোলায়েমভাব বজায় রাখে। গাছের স্বাভাবিকতাকে ধরে রাখে। শুধু জৈব পদ্ধতিতেই বাগান করা যায়, গাছ সুন্দর রাখা যায়; তবু কিছু কিছু ক্ষেত্রে কখনও কখনও আমাদের রাসায়নিক সারের শরণ নিতে হয়। কেন ও কীভাবে নিতে হয় এবং কীভাবে এই দুই ধারাকে মিলিয়ে আমাদের বাগানের গাছপালাকে সুন্দর করে রাখতে হয়—সে-কথা বলব আগামি পর্বে।...   

                        

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...