বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত পঞ্চমন্দির

বাংলায় টেরাকোটার স্থাপত্য শিল্পকলার নিদর্শন বিষ্ণুপুর। মন্দিরের প্রাচুর্য বিষ্ণপুরকে "মন্দিরনগরী" নামে খ্যাত করেছে। রাসমঞ্চ, শ্যামরাই মন্দির, জোড়বাংলা, মদনমোহন মন্দির, লালজী মন্দির-এই পাঁচটি মন্দির অনন্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে স্বমহিমায় বিরাজমান। মল্লরাজারা এই মন্দিরগুলি নির্মাণ করেন।

 

মন্দিরগাত্রে শিল্পীর হাতের পোড়ামাটির নিপুণ কারুকাজ পুরাণের গল্প-গাথা, তৎকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক জীবন, রামায়ণ-মহাভারতের চরিত্রগুলির প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছে। বিষ্ণুপুরের প্রতিটি মন্দিরের অন্তরাত্মা যেন 'ক্ষুধিত পাষাণ'। এক অমোঘ টান অনুভব হয় দর্শনার্থীর মনে, ''সমস্ত বাড়ি একটা সজীব পদার্থের মতো আমাকে তাহার জঠরস্থ মোহরসে অল্পে অল্পে যেন জীর্ণ করিতে লাগিল। বোধ হয় এ বাড়িতে পদার্পণমাত্রেই এ প্রক্রিয়ার আরম্ভ হইয়াছিল। ' মন্দিরাভ্যন্তরের শান্ত ও শীতল পরিবেশ শরীরকে অবশ করে তোলে। বর্তমানে পা রেখে অতীতের ঐতিহ্য অনুভব, এখানেই বিষ্ণুপুরের সার্থকতা।

 

বিষ্ণুপুরের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরের অতীত ইতিহাসকথা:

 

রাসমঞ্চ: রাসমঞ্চের উপরিভাগ পিরামিড আকৃতির, মধ্যভাগ বাংলার চালার অনুরূপ এবং নীচের অংশটি মুসলিম অনুকরণে নির্মিত। মঞ্চের বেদি মাকড়া পাথরে প্রস্তুত। বেদিটির উচ্চতা ১.৬ মিটার ও দৈর্ঘ্য ২৪.৫ মিটার। দেওয়াল জুড়ে টেরাকোটা শৈলীতে পোড়ামাটির নিখুঁত কারুকাজ।

bishnupur1

মল্লরাজারা রাসপূর্ণিমায় রাধাকৃষ্ণের মূর্তি এখানে আনয়ন করতেন, তখন থেকেই নাম হয় রাসমঞ্চ। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাসপূর্ণিমায় বিশেষ অনুষ্ঠান পালিত হত কিন্তু ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের আওতায় আসার পর থেকে সে অনুষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। মল্ল রাজবংশের ৪৯তম শাসক হাম্বির ১৫৫৮ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে বসেন। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রাসমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।মন্দির স্হাপনের পেছনে রয়েছে ছোটো ইতিহাস।

 

নরোত্তম দাস রচিত "প্রেমবিলাস" ও নরহরি চক্রবর্তী রচিত "ভক্তিরত্নাকর" গ্রন্থ থেকে জানা যায়, শ্রীনিবাস বৃন্দাবন থেকে গৌড় যাচ্ছিলেন, পথমধ্যে হাম্বির নেতৃত্বে লুন্ঠিত হন। কিন্তু শ্রীনিবাসের ভাগবত পাঠ শুনে মল্লরাজ হাম্বির বৈষ্ণবধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়ে বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে প্রভাবান্বিত হয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

 

শ্যামরায় মন্দির: ১৬৪৩ খ্রিষ্টাব্দে মল্লরাজ রঘুনাথ সিংহ এই দেবালয় নির্মাণ করেন। মাকড়া পাথরে প্রস্তুত পাঁচ শিখরবিশিষ্ট বিষ্ণুপুরের শ্রেষ্ঠ পঞ্চরত্ন মন্দির এটি। সবার উপরের শিখর অষ্টভুজ বাকি চারটি চতুর্ভূজ। ইসলামিক আদলে তৈরী মাঝের শিখরটি, বাকি চারটি শিখর উড়িষ্যার মন্দিরানুরূপ, নীচের অংশ বাংলার চালার অনুরূপ।

bishnupur2

মন্দিরটি দৈর্ঘ্য ও প্রস্হে ১১.৪ মিটার, সর্বোচ্চ শিখরটির উচ্চতা ১০.৭ মিটার। মুরলীধর কৃষ্ণের গোপিনী সহযোগে নিখুঁত কারুকাজ রয়েছে মন্দিরগাত্রে। গান্ধার শিল্পের নমুনা লক্ষ্য করা যায়। মন্দিরের উৎসর্গলিপিতে মল্ল রাজাদের সৃষ্ট মল্লাব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। বালুচরি শাড়িতে রাসমন্ডলের যে চিত্র দেখতে পাই তা আসলে এই মন্দিরের পোড়ামাটির কাজগুলির অনুকরণমাত্র।

 

জোড়বাংলা: ১৬৫৫ খ্রিষ্টাব্দে জোড়বাংলা মন্দিরটি মল্ল রাজা রঘুনাথ সিংহ নির্মাণ করেন। দোচালা-বিশিষ্ট দুটি মন্দির-ঘর পরস্পর সংযুক্ত হওয়ায় একে জোড়বাংলা নামকরণ করা হয়। সংযুক্ত দোচালা মন্দির-ঘরের মধ্যস্হলের চূড়াটি চারচালাবিশিষ্ট। এই মন্দিরটি 'কেষ্টরায়' মন্দির নামেও পরিচিত। মন্দিরের দৈর্ঘ্য ১১.৮ মিটার, প্রস্থ ১১.৭ মিটার ও উচ্চতা ১০.৭ মিটার।

bishnupur3

রামায়ণ, মহাভারত, পৌরাণিক উপাখ্যান পোড়ামাটির মন্দিরগাত্রে জীবন্ত হয়ে উঠেছে শিল্পীর খোদাইয়ে। বাঘ, হাতি, উট, ঘোড়া ইত্যাদি পশুর চিত্রণ, শিকারের দৃশ্য; মল্লযুদ্ধ চিত্র, নৌবাহন ও নৌবাহনে যুদ্ধের চিত্র থেকে আন্দাজ করা যায় সামরিক প্রগতিশীল মনোভাব; তৎকালীন যুগের ঘরোয়া মহিলাদের সাজসজ্জা সম্পর্কে আভাস পাওয়া যায় (ঘোমটা মাথায় রমণী, মুকুর হাতে চুল আঁচড়াচ্ছেন কেউ, কারো হাত সীমন্তরেখায় স্তব্ধ); বিষ্ণুর দশাবতার রূপ, ভীষ্মের শরসজ্জা, ধনুর্বাণ অর্জুনের গল্প, রাম-সীতার বিবাহ, বনবাস পর্ব, লক্ষ্মণ ও শূর্পণখার গল্প, অহল্যা উদ্ধার, তারকারাক্ষস বধ, বালি-সুগ্রীবের যুদ্ধ, কালিয়া দমন, বকাসুর বধ কাহিনী দেওয়ালে খোদিত আছে। বিশেষ গঠনশৈলীর কারণেই বর্তমানে ইকোপার্কে আমরা এর অনুরূপ নবনির্মাণ দেখতে পাই।

 

মদনমোহন মন্দির: মল্লরাজ দুর্জন সিংহ দেব ১৬৯৪ খ্রিষ্টাব্দে মদমোহন মন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ১২.২ মিটার এবং উচ্চতা ১০.৭ মিটার। লোকগাঁথা অনুসারে, একসময় মন্দিরের বিগ্রহ চুরি হয়ে গেছিল কিন্তু পুরোহিত সে রাত্রেই স্বপ্নাদেশ পান এবং বিগ্রহ উদ্ধার করেন। রাধাকৃষ্ণ এখানে প্রত্যহ ভক্তিসহকারে পূজিত হন।

bishnupur4

তবে পূর্বে এখানে অষ্টধাতুর মদনমোহন বিগ্রহ ছিল। বিষ্ণুপুরের ৫৬ তম রাজা চৈতন্যদেবের আমলে রাজস্ব দেনায় অষ্টধাতুর বিগ্রহটি বন্ধক রাখতে হয়। বর্তমানে বাগবাজার মদনমোহন মন্দিরে এই মূর্তিটি রয়েছে। বিষ্ণুপুরের মদনমোহন মন্দিরের সামনে পোড়ামাটি ও টেরাকোটার দ্রব্যাদির দোকান বসে।

 

লালজী মন্দির: ১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দে মল্লরাজ বীরসিংহ প্রাচীরবেষ্টিত একরত্ন মন্দিরটি নির্মাণ করেন। এই মন্দিরের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ১২.৩ মিটার এবং উচ্চতা ১০.৭ মিটার। বর্তমানে মুক্ত উদ্যান প্রাঙ্গণটিকে সাজিয়ে তোলা হয়েছে, বসবার সুব্যবস্থা রয়েছে। মন্দিরটির ঢালু ছাঁদের মধ্যস্থলে একটি উঁচু শিখর রয়েছে, যা দূর-দূরান্ত থেকে চক্ষুগোচর হয়।

bishnupur5

পূর্বে এলাকাটি ঘন জঙ্গলবেষ্টিত থাকায় এরূপ নির্মাণকৌশল ব্যবহৃত হয়েছে। মন্দির প্রাঙ্গণে রয়েছে একটি তুলসীমঞ্চ ও কুয়ো। কল্পনা করা যায়, পূর্বে পূজার্চনায় এই কুয়োর জল ব্যবহৃত হত। মন্দিরের উৎসর্গলিপিতে উল্লেখ আছে শ্রীরাধিকা ও কৃষ্ণের নান্দনিকতার কথা ভেবেই বীরসিংহ এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরের পাশেই রয়েছে একটি ঘাট বাঁধানো পুষ্কিরিণী, ঘাটের সিঁড়ি প্রায় অবলুপ্ত। তবু মানুষের কোলাহল মুখরতা, শিশুদের জলকেলিতে ইতিহাস যেন বধিরতা কাটিয়ে ওঠে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...