কলকাতার মাঝমাঝি, কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে ধর্মতলা অবস্থিত। কলকাতাকে দু-ভাগে ভাগ করেছে ধর্মতলা। আজ্ঞে হ্যাঁ! এর দুপাশে দুটি কলকাতা অবস্থান করে। একদিকে সাবেক কলকাতা, আরেকদিকে আকাশঝাড়ু আধুনিক কলকাতা। গড়ের মাঠ অধুনা ময়দান, মনুমেন্ট, টিপু সুলতান মসজিদ, রসগোল্লার পীঠস্থান কে সি দাস, হগ সাহেবের মার্কেট আধুনা নিউ মার্কেট, সারা বাংলায় ছড়িয়ে যাওযার বাস ডিপো, ট্রাম ডিপো, সব মিলিয়ে একে কলকাতার খাস তালুক বলাই যায়। খাস তালুকই বটে, আজকের ওয়েলিংটন স্কোয়ারের একদা নাম ছিল ধর্মতলা স্কোয়ার। একদিকে চলে গিয়েছে পার্কস্ট্রিট, অন্যদিকে সেন্ট্রাল চাঁদনি, এসপ্ল্যানেড রো এসে রাস্তা পেরিয়ে লেনিন সরণি। এই সব মিলিয়েই ধর্মতলা।
এ বছর বুদ্ধ পূর্ণিমায় সেই ধর্মতলায় শুরু হয়েছে ধর্ম ঠাকুরের পুজো। মঙ্গলবার শেষ হবে পুজো। প্রধানত বাংলার রাঢ় বাংলার দেবতা ধর্ম ঠাকুর। ধর্ম ঠাকুরের নিজস্ব কোনও মূর্তি নেই। একটি এবড়োখেবড়ো প্রস্তর খণ্ডকে সিঁদুর-চন্দন পরিয়ে ডোম, বাউড়ি সম্প্রদায়ের মানুষেরা এই দেবতার উপাসনা করেন। এক কালে কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলায় ধর্মঠাকুরের পুজো হত। কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত বইতে বিনয় ঘোষ ধর্মতলার নামকরণ প্রসঙ্গে লিখে গিয়েছেন, ওই এলাকায় বহুকাল আগেই ধর্মঠাকুরের মন্দির ছিল। তা থেকেই এলাকার নাম হয়েছে ধর্মতলা। সেই ঐতিহ্যই ফিরিয়ে আনা হল।
অমলেন্দু মিত্রের লেখা রাঢ়ের সংস্কৃতি ও ধর্মঠাকুর বই থেকে জানা যায়, রাঢ়ের বিভিন্ন জায়গায় বুদ্ধ পূর্ণিমার সময় ধর্ম ঠাকুরের পুজো হয়। বিভিন্ন গবেষকদের মতে, ধর্মঠাকুর হল বৌদ্ধদের দেবতা। সেন যুগের প্রাককালে শৈবরা বৌদ্ধদের অপসারিত করে ধর্ম ঠাকুরের থানের উপর অধিকার বিস্তার করে। শৈবরা পাঁঠা বলি দিয়ে থানের পবিত্রতা নষ্ট করে অধিকার ন্যস্ত করে। প্রচলিত বিশ্বাস মতো, ধর্ম ঠাকুর আদপে শিবই।
তবে ধর্ম ঠাকুর কোনও একক দেবতা ছিলেন না। তিনি নানা মতের নানান দেবতার মিশেল। মূলত ডোম জাতির আরাধ্য ছিলেন তিনি। আর্য-অনার্যদের আরাধ্য নানা দেবতার মিশেলে তৈরি হয়েছিলেন এই দেবতা। সুকুমার সেনের মতে, ধর্ম ঠাকুরের পুজো পদ্ধতিতে বৈদিক এবং পৌরাণিক আর্য, অনার্যর উভয় পদ্ধতির সমাবেশ হয়েছিল। শিবের গাজন যেমন বিখ্যাত, তেমনই ধর্ম ঠাকুরের পুজোতেও গাজনের রীতি ছিল বঙ্গে। এখনও কোথাও কোথাও তা অক্ষত রয়েছে। ধর্ম ঠাকুরের পুজোয় নাচের প্রচলন অবশ্য ছিল। শিবের গাজনের মতোই, ধর্ম-গাজনে নাচের নাম ছিল পাতা-নাচ। মদ্যের নৈবেদ্য দেওয়ারও চল ছিল। কোথাও কোথাও তিনিই ধর্মরাজ বা ধর্ম নামেও পূজিত হন। নির্দিষ্ট আকারহীন প্রস্তরখণ্ডে তেল-সিঁদুর মাখিয়ে ধর্মঠাকুরের পুজো করা হয়। মূলত থানে ধর্মঠাকুরের পুজো করা হয়। পাথরের খণ্ডটিকে গাছের তলায় রেখে, বা উন্মুক্ত স্থানে রেখে ধর্মঠাকুরের আরাধনা করা হয়। কোথাও কোথাও আবার মন্দিরে রেখে পুজো করা হয়।
বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিতে, ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির দিন ধর্মঠাকুরের বিশেষ পুজা হয়। ধর্মঠাকুর কোনও একক দেবতা নন, বরং তিনি নানান মতের দেবতাদের সমাহার। আর্য-অনার্যদের আরাধ্য দেবতাদের মিশেলে তৈরি হয়েছিল বাংলার এই লৌকিক দেবতা। বাউড়ি, বাগদি, হাড়ি, ডোম সম্প্রদায়ের মানুষরা ধর্মঠাকুরের পুজো করেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতো পণ্ডিতরা, ধর্মঠাকুরকে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতীক হিসেবে দেখেছেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, লোকবিশ্বাসে ধর্মঠাকুরের স্থান ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবেরও চেয়েও উপরে। ধর্মঠাকুরের বাহন নিয়েও নানা মতভেদ রয়েছে। কোথাও কোথাও ধর্ম ঠাকুরের বাহন হিসেবে ঘোড়া দেখা যায়। আবার কেউ কেউ হাতিকেও ধর্মঠাকুরের বাহন বলে মনে করেন।
কিন্তু রাজনৈতিক মিটিং-মিছিল, তরজা-কাজিয়া, খেলা, বেতার সবেতে মুখরিত ধর্মতলা, ধর্মতলা হল কী করে? ধর্মতলা নামটা এল কোথা থেকে?
সাহেবি কলকাতায় জনবহুল ধর্মতলা ছিল, সুপরিকল্পিত ভাবে সাজানো এবং পরিষ্কার-পরিছন্ন। জেমস লং-এর বিবরণ থেকে জানা যায়, আজ যেখানে টিপু সুলতান মসজিদ রয়েছে, তার পাশে ছিল মেসার্স কুক কোম্পানির ঘোড়ার আস্তাবল। ওই আস্তাবলের জমিতে সুপ্রাচীন কালে একটি মসজিদ ছিল যা বর্তমানে আর নেই, এই মসজিদ প্রাঙ্গনেই তাৎকালীন কলকাতার কারবালা সমাবেশ হত, তাই ধর্মীয় সমাবেশ থেকেই সম্ভবত ধর্মতলা নামের জন্ম। হালের টিপু সুলতান মসজিদটি, ১৮৪২ সালে টিপু সুলতানের উত্তরপুরুষ প্রিন্স গোলাম মহম্মদ তৈরি করেন।
অন্য একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, জানবাজার অঞ্চলে বসবাসকারী বৌদ্ধধর্মাবলম্বী মানুষেরা নানান ধর্মীয় অনুষ্ঠান এখানে করতেন, সেই থেকে ধর্মতলা নামের উৎপত্তি। কর্ণেল ডা: হলের মতানুযায়ী, ধর্মতলা-জানবাজার এলাকায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের একটা আড্ডা বসত। সেখান থেকেই সম্ভবত ধর্মতলা নাম হয়েছে। আবার ধর্মতলা স্ট্রিটে গির্জাও রয়েছে।
আধুনিক কলকাতা গবেষকদের মতে, ধর্মঠাকুরের থেকেই ধর্মতলার নামটির উৎপত্তি হয়েছে। রাঢ় বাংলার লৌকিক দেবতা হলেন ধর্মঠাকুর। পল্লী বাংলার লৌকিক দেবতাদের মধ্যে তিনিই জনপ্রিয়তম। ডোম, বাউরি, বাগদিরা মূলত ধর্মঠাকুরের পুজো-উপাসনা করেন।
ধর্মতলা অঞ্চলের আশেপাশে তখন তথাকথিত সমাজের নিম্নবর্ণের মানুষেরা বসবাস করতেন এবং তারা মহাসমারোহেই ধর্মঠাকুরের পুজো করতেন। এই এলাকায় একাধিক জায়গায় ধর্মঠাকুরের পুজো হত। ৪৫ নং সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় রোডে আজ ধর্ম ঠাকুরের মন্দির দেখতে পাওয়া যায়। ধর্মঠাকুর আবার বাঁকা রায়, চাঁদ রায়, কালু রায়, দলু রায় ইত্যাদি নামেও পরিচিত। ওয়েলিংটন স্কোয়ার থেকে একটি রাস্তা ধর্মতলা স্ট্রিটে এসে মিশত, বাঁকা রায় স্ট্রিট। এই বাঁকা রায়ই হলেন ধর্মঠাকুর, আদপে ধর্ম ঠাকুরের বহু নাম রয়েছে তার মধ্যে বাঁকা রায়ও একটা।
এই ঐতিহাসিক তথ্যগুলোই প্রমান করে ধর্ম সংক্রান্ত কারণেই এলাকার এমন নাম হয়েছে। গোদা বাংলায় যে রাস্তা ধরে ধর্ম ঠাকুরের থানে যাওয়া হত তাই ধর্মতলা রোড। এই চত্বরকেই আজ এসপ্ল্যানেড বলি। ধর্মতলা থেকে চাঁদপাল ঘাট পর্যন্ত ছিল এসপ্ল্যানেডের বিস্তার, এসপ্ল্যানেড শব্দটির দুটি অর্থ হয়, এক জলাশয়ের তীরবর্তী অঞ্চল আর দ্বিতীয় দুর্গ ও শহরের মধ্যবর্তী সমতল অঞ্চল। আমাদের এসপ্ল্যানেড হল আজকের ফোর্ট উইলিয়াম আর কলকাতার মাঝের এলকা, সমতল, প্রশস্ত, কাছেই বইছে গঙ্গা।
তবে এই প্রসঙ্গে বলি কলকাতায় আরও একটি ধর্মতলা রোড রয়েছে, সেটি কসবায় অবস্থিত। এখানেও ধর্ম ঠাকুরের মন্দির রয়েছে, ১১/১ ধর্মতলা রোড, কসবায় ধর্ম ঠাকুরের মন্দিরটি অবস্থিত। অতএব এ ধারণা স্পষ্ট হয় যে ধর্ম ঠাকুরের থান থেকেই শহর কলকাতায় ধর্মতলা রোডের জন্ম হয়েছে।