নারী শিক্ষা,নারী স্বাধীনতা ,নারীর অধের্ক আকাশের স্বীকৃত সত্ত্বা নিয়ে আজ এতো কাজ হচ্ছে , কথা হচ্ছে তবে এর সূচনা হয়েছিল প্রায় ১৫০ বছর আগে কিছু মানুষের হাত ধরে এবং ভাবতে অবাক লাগলেও প্রায় ১৫০ বছর আগে এ কাজে সফল ভূমিকা পালন করে একটি পত্রিকা- যা দায়িত্ব নিয়ে প্রতিনিয়ত সামাজিক বদ্ধমূল ধারণার মূল কেন্দ্রে কুঠারাঘাত করতে থাকে। আজ সেই তথ্যই দেব।
১৫৭ বছর আগের সমাজের প্রথা ভেঙে নারী শিক্ষার যে ভীত তৈরী হয়েছিল তার ফল আজ নারীদের মাথা উঁচু করে বাঁচার প্রবণতা , সাফল্য , সবটা। কিন্তু সর্বস্তরে তার যথার্থ বিকাশ আদৌ ঘটে নি। মূলত মানসিক কিছু কূপমণ্ডূকতা আজও আছে , শিক্ষার অভাব , পারিবারিক সীমাবদ্ধতা এসব দায়ী - কন্যা সন্তান বাঁচানো ও তাদের যথার্থ বিকাশে সরকার উদ্যোগী হচ্ছে , কিন্তু তা এক্কেবারে তৃণমূল স্তরে কতটা কার্যকরী হচ্ছে তা বলা বাহুল্য। কিন্তু প্রায় ১৫৭ বছর আগে বেশ কিছু পত্রিকা এ কাজে অগ্রণী হলেও ,সাফল্যের সাথে দীর্ঘায়ু লাভ করেছিল যে পত্রিকাটি তা - বামাবোধিনী।
সময়টা এককথায় নবজাগরণের। ডিরোজিও ,রামমোহনের হাত ধরে সবেমাত্র আলোড়ন সৃষ্টি হতে শুরু করেছে , সবদিক থেকে আন্দোলন না হলেও, কুসংস্কার , ধর্মীয় গোঁড়ামি, বদ্ধ ভাবনার মুলে চরম কুঠারাঘাত শুরু হয়। তাই বা কম কি ! অত দিন আগে কি সাংঘাতিক জ্ঞানালোকের বিচ্ছুরণ শুরু হয় , যাকে সমাজের সর্বস্তরে প্রভাবিত করে মূলত বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ করানো নেহাত সহজ ব্যাপার ছিল না। আর নারীমুক্তি – তারও সূচনা হয় উনিশ শতকে রামমোহনের হাত ধরে।ব্রাহ্মণ সমাজের সুতীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও তাঁর চেষ্টায় বন্ধ হলো সতীদাহ । ঐ একই সময় বিদ্যাসাগর নারী শিক্ষার দীর্ঘ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটান।চিরকালীন নারীদের পর্দার আড়ালে,কুসংস্কারের জালে জড়িয়ে রাখার প্রবণতার বিরুদ্ধাচারণের প্রথম পদক্ষেপে গোটা সমাজ এক্কেবারে উত্তাল হয়ে পড়লো। ইতিমধ্যেই প্যারীচাঁদ মিত্র ও রাধানাথ শিকদারের সম্পাদনায় নারীশিক্ষা-বিষয়ক পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়১৮৫৪ সালে। আর তাতে উঠে আসে তাদের ওপর সামাজিক অত্যাচারের বিষয়। কিন্তু দ্রুতই তার আয়ু ফুরোয়। এর কিছুকাল পর ১৮৬৩ সালের আগস্ট মাসে উমেশচন্দ্র দত্তের তাগিদেই প্রকাশ হয়েছিল বামাবোধিনী পত্রিকা। উদ্দেশ্য ছিল অন্দরমহলে শিক্ষাকে প্রবেশ করানো। শিক্ষার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক অনেক দূরের হওয়ায় শিক্ষালাভে তাদের তেমন আগ্রহ ছিল না। তাই নারীকে শিক্ষিত করতে তার সার্বিক উন্নয়নে পত্রিকাটি প্রকাশ হয়। সবথেকে বড়ো ব্যাপার, পত্রিকাটি চলেছিল দীর্ঘ ষাট বছর। আর এই ষাট বছরে নারীকে ভাষাজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস, জীবনচরিত, বিজ্ঞান, নীতি, ধর্ম ও আরো নানা বিষয়ে শিক্ষিত করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে সাফল্যের সঙ্গে এই বামাবোধিনী।
উমেশচন্দ্র ছিলেন ব্রাহ্ম। প্রথমদিকে কেশব সেনের অনুসারী হলেও পরে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের অংশ হয়ে পড়েন। পত্রিকা প্রকাশে ক্ষেত্রমোহন, বসন্তকুমার দত্তের সহযোগিতায় দীর্ঘ চুয়াল্লিশ বছর আমৃত্যু তিনি পত্রিকাটির সম্পাদনা করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে গিয়ে মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার এই উদ্যোগ – সাধুবাদের দাবিদার।বামাবোধিনীর-উদ্দেশ্য ছিল যুক্তিবাদী, সংস্কারমুক্ত নারী শিক্ষা - সর্বোপরি উন্মুক্ত চিন্তার সমাজ। তাই এর বড়ো অংশ জুড়ে থাকত জ্ঞানবিজ্ঞান ও কুসংস্কার সম্পর্কিত আলোচনা। দীর্ঘ ষাট বছরের এমন একটি সফল উদ্যোগে জুড়ে ছিলেন সেসময়ের অনেক নারী সাহিত্যিক- রাসসুন্দরী দেবী ,জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, সরলা দেবী, স্বর্ণকুমারী দেবী, বেগম রোকেয়া প্রমুখ।সঙ্গে থাকত পারিবারিক চিকিৎসা পদ্ধতি, শিশুসুরক্ষার বিষয়ও। তৎকালীন সময়ে বামাবোধিনী ছিল অত্যাধুনিক।বলতে দ্বিধা নেই আজ যতটা রাস্তা অতিক্রান্ত করেছেন নারীরা তার জন্য প্রথম মাইল ফলকটি ওই বামাবোধিনী সৃষ্ট।