বিজ্ঞানের ছোঁয়ায় আধুনিক জীবন , সমাজ যতই প্রগতিশীল হোক না কেন এই বিশ্বে যে কত রকমের বিস্ময় আছে তা এক জীবনে প্রত্যক্ষ করা বেশ দুস্কর , তবে অসম্ভব নয় কারণ আজ হয় তা আমাদের হাতের মুঠোতে না হয় মানুষই সেখানে পৌঁছে যাচ্ছে তার অদম্য ইচ্ছা, কৌতুহল ও নতুনকে জানার ইচ্ছের উপর ভর করে । প্রকৃতি নিজেকে ঠিক কেমন ভাবে সাজাবে তার অবর্ণনীয় হদিশ পাবেন এই বলিভিয়ায় , কি অভূতপূর্ব বিস্ময় অপেক্ষা করছে তা কল্পনাতীত।
বলিভিয়ায় অবস্থিত চমকপ্রদ এই প্রাকৃতিক অঞ্চল বিশ্বের সর্ব বৃহৎ লবন সমভূমি -'সালার -দি-ইউনি’।বলিভিয়ার অন্তর্গত আল্টিপ্লানো মালভূমির একটি অংশ 'সালার -দি-ইউনি 'অতীতে সমুদ্রের নিচে ছিল। আন্দিজ পর্বতমালা গঠনের সময় এই অঞ্চলের ভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কয়েক হাজার ফুট উপরে উঠে যায়। এরপর প্রায় ৩০ -৪০ হাজার বছর আগে এখানে তৈরী হয় 'লেক মিনচি ' নামক এক হ্রদের। কয়েক হাজার বছরের বিবর্তনে সেই লেকের জল শুকিয়ে জমে থাকে লবন সহ বিভিন্ন খনিজ উপাদান।
বর্তমানে 'সালার - দি -ইউনি ' সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২০০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত, আয়তন প্রায় ১০ হাজার ৫৮২ বর্গ কিলোমিটার। বর্ষাকালে এখানেই জল জমে এই ‘প্রাকৃতিক আয়নার’ সৃষ্টি হয়। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তৈরী হওয়া এই আয়নায় নীল আকাশের প্রতিবিম্ব তৈরী হয়,যা অভুতপূর্ব। এই সৌন্দর্যের কারণে সারা বিশ্বের ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে এই স্থান অতি আকর্ষণীয়।
এখানে ঘুরতে চাইলে নিকটবর্তী শহর থেকে পর্যটকদের জন্য গাড়ি ভাড়া নিয়ে আসতে হয়। প্রতিদিন এমন ২০০ টি গাড়ি ভর্তি পর্যটক আসেন। এই 'সালার – দি- ইউনি ‘র মাঝে বেশ কিছু ছোট ছোট দ্বীপ আছে ,এই সব দ্বীপ থেকে উপভোগ করা যায় এই আয়নাভূমি। দ্বীপগুলিতে আছে প্রায় কয়েকশো বছরের পুরোনো ক্যাকটাস। এখানকার সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত সারা বিশ্বের অপার্থিব সৌন্দর্যের অন্যতম। চমকপ্রদ এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য আছে বিশেষ ব্যবস্থা। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকদের জন্য আছে এখানে একাধিক হোটেল। কিন্তু সেগুলোর মধ্যেই সবচেয়ে ব্যতিক্রমী – ‘প্যালাসিও -দি -সাল '- যার অর্থ লবণের প্রাসাদ। এটি আবার অন্যতম বিস্ময়। ২০০৭ সালে গড়ে ওঠা এই হোটেলটি আক্ষরিক অর্থেই ' লবন প্রাসাদ '. কারণ হোটেলটির মেঝে , দেওয়াল , ছাদ এমনকি টেবিল, খাটসহ সব আসবাব তৈরী হয়েছে -লবণের খন্ড দিয়ে। গোটা হোটেলটি নির্মাণে প্রায় ১৪ ইঞ্চি দৈর্ঘের ১০ লক্ষ নুনের ইট ব্যবহৃত হয়েছে।
এটি শুধু পর্যটন কেন্দ্র নয় উন্মুক্ত খনিও বটে। স্থানীয় আইমারা জনগোষ্ঠী এখানকার লবন সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে। ধারণা করা হয় , এখানে ১১০০ কোটি টন লবন আছে। এর প্রবেশ পথে একটি রেলগাড়ির সমাধি আছে। অতীতে এসব ট্রেনের মাধ্যমে লবন পরিবহন করা হতো। স্থানীয় আদিবাসীদের প্রবল আপত্তিতে ট্রেনের সাহায্যে এখান থেকে লবন সরবরাহ বন্ধ করা হয়। এর পাশাপাশি বিপুল পরিমানে পাওয়া যায় 'লিথিয়াম’ ধাতু। আমাদের স্মার্ট ফোন থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারী তৈরিতে এটি ব্যবহৃত হয়। এখানে ৯০ লক্ষ টন লিথিয়াম মজুত আছে , যা সমগ্র পৃথিবীতে প্রাপ্ত লিথিয়ামের ৫০%.
মহাকাশ থেকে ছবিতে এই সালার -দি-ইউনি যে ব্লকের মতো ছবি দেখা যায় তা লিথিয়ামের পুকুর। আল্টিপ্লানো মালভূমি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ মালভূমি । কিন্তু এই অভূত পূর্ব সৌন্দর্যের সাথে অনুভূতির মেলবন্ধন চাইলে যেতেই হবে এই সালার - দি- ইউনি তে। নিজেকে তো রোজ আয়নায় দেখেন, স্মার্টফোনের দৌলতে তোলেন সেলফিও। কিন্তু প্রকৃতিও যে বিশাল আয়না তৈরী করে প্রতি মুহূর্তের সেলফি তুলে চলছে সেই ঘটনার সাক্ষী হতে আসতে পারেন এখানে, যা এখন আর দূর নয়।