সিনেমা-নাটকের নারীচরিত্রে পুরুষের অভিনয়ের কথা তো আমরা জানি, কিন্তু, নারী হয়েও কানন দেবীর অভিনয় জীবনে পুরুষ চরিত্রে অভিনয়ের নজির রয়েছে। তখন তাঁর চোদ্দ-পনেরো বছর বয়স। 'প্রহ্লাদ' (১৯৩১)-ছবিতে নারদ এবং 'বিষ্ণুমায়া' (১৯৩২)-ছবিতে নারায়ণ ও কৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় করেন। তাঁর আগে শিশু ও কিশোর চরিত্রে অবশ্য মেয়েদের অভিনয় করতে দেখা গেছে। কিন্তু, যুবা-পুরুষ চরিত্রে তিনিই প্রথম। ম্যাডান থিয়েটারের টকি-সিনেমায় তখন এক ছবিতে নায়িকা, অন্য ছবিতে পুরুষ--এমনই বিপরীত চরিত্রে পাশাপাশি দাপিয়ে অভিনয় করে চলেছেন কানন। তাই একসময় 'অমৃত বাজার পত্রিকা' তাঁকে শিরোপা দিল, 'ফার্স্ট লেডি অব বেঙ্গলি স্ক্রিন'। অথচ, এই অভিনয়-জীবনে তিনি আসতে চাননি। আসতে বাধ্য হয়েছিলেন নিতান্তই পেটের দায়ে!
না, গরীবের ঘরে তাঁর জন্ম হয়নি। বাবা রতনচন্দ্র দাস মার্চেন্ট অফিসে কাজ করতেন। তাছাড়া একটা সোনারূপোর গয়নার দোকানও তাঁর ছিল। কিন্তু, চরিত্র ভালো ছিল না। নানান বদনেশায় টাকাপয়সা উড়িয়ে অনেক বদনাম, বিপুল ঋণের বোঝা এবং দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে রেখে তিনি হঠাৎ মারা গেলেন। দিয়ে গেলেন শুধু বড় মেয়েটির বিয়ে। কানন তখন নিতান্তই নাবালিকা। তাঁর স্কুলে যাবার ইচ্ছে, ডাক্তার হবার স্বপ্ন সব শেষ হয়ে গেল। ঘরবাড়ি, দোকান, গয়না, আসবাব--যা ছিল সব বিক্রি করে শেষমেশ হাতেপায়ে ধরে মা-মেয়ে এক আত্মীয়ের আশ্রিত হলেন। হয়ে উঠলেন সে-বাড়ির কাজের লোক। অকথ্য অত্যাচার আর চোখের জল হল নিত্যসঙ্গী। চোখের জল তো কাননের আজকের সঙ্গী নয়। সেই ছোট্ট থেকে পাড়াপড়শির কাছে দিনের পর দিন শুনতে হয়েছে তাঁর বাপের বদ কাজের ফিরিস্তি, তাঁর বাপ-মায়ের বিয়ে না করে সন্তান জন্ম দেওয়ার কদর্য ইঙ্গিত, আর তার জন্য বাঁকা হাসি আর দুরছাই! এসব তো চোখের জলেই শেষ হয়ে যায়নি, তাঁর শিশুমনটিকেও যে নির্মমভাবে ক্ষতবিক্ষত করেছে! খোলামেলা মনটাকে অন্তর্মুখী করে তুলেছে। এই অন্তর্মুখী মনটাই একদিন চোয়াল শক্ত করে বিদ্রোহ করে বসল। যেদিন মায়ের হাত ফস্কে প্লেট পড়ে ভেঙে যেতেই সবাই যেন একযোগে মা ও মেয়েকে মারতে এলো; সেদিন সবাইকে স্তম্ভিত করে প্রতিবাদ করে উঠলেন কানন। আর পারছিলেন না মাও। মেয়ে হাত ধরতেই, মাও বেরিয়ে এলেন। আশ্রয় নিলেন সস্তার এক ভাড়া বাড়িতে।
আশ্রয় জুটল। কিন্তু, আহার? কোনদিন আধপেটা, কোনদিন শুধু জল। কাজ জুটল না। বাঁচতে হলে ভিক্ষে ছাড়া উপায় রইলো না। এই অবস্থায় পারিবারিক বন্ধু, কাননের 'কাকাবাবু', ম্যাডান থিয়েটারের অভিনেতা তুলসী বন্দোপাধ্যায় ত্রাতা হয়ে নিয়ে এলেন অভিনয়ের প্রস্তাব। তিনি কাননকে বললেন, 'তোমার চেহারা ভালো। একবার যদি চান্স পাও ব্যস আর দেখতে হবে না।' কাননের বয়স তখন সবে দশ। মা কিছুতেই রাজি হলেন না। শুনেছেন সিনেমার জগৎ নোংরা জগৎ! স্বামীর বদনাম তো এতকাল সহ্য করেইছেন, এবার পেটের দায়ে মেয়েকে সে পথে ঠেলে দেবেন? না না, এর চেয়ে মরাই ভালো। কিন্তু, কানন বুঝেছিলেন এ ছাড়া তাঁর ও মায়ের আর গতি নেই। সংসারের হাল তাঁকেই ধরতে হবে। অনেক অনুনয়ে শেষমেশ মা রাজি হলেন।
১৯২৬ সাল। চলচ্চিত্রের নির্বাক যুগ। কাজ পেলেন, পরিচালক জ্যোতিষ বন্দোপাধ্যায়ের, 'জয়দেব'-ছবির 'রাধা' চরিত্রে। এতে অনাহার পিছু ছাড়ল বটে, বঞ্চনা ছাড়ল না। প্রাপ্য পঁচিশ টাকা এ-হাত ও-হাত বেয়ে আসতে আসতে তাঁর কাছে যখন পৌঁছল, তখন হয়ে গেল মাত্র পাঁচ টাকা। কুড়ি টাকা গেল, তবু ক'দিন পেট চলার তো একটা উপায় হল!
বুদ্ধিমতী কানন অভিনয় করতে এসে বুঝলেন, শিক্ষা চাই। সাহিত্য-শিল্পের শিক্ষা। তাই তিনি যখন মাস মাইনের শিল্পী হলেন, খাওয়াপরার অভাব ঘুচল; তখন আল্লারাখা নামের এক ওস্তাদজীকে রাখলেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শেখার জন্য। তবলাও শিখলেন। মেকআপ ও শ্যুটিং-এর অবসরে রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবত-পুরাণ শোনানোর জন্য রাখলেন একজন পণ্ডিত। একজন শিক্ষক রাখলেন হাল আমলের কবিতা-গল্প-উপন্যাসের পাঠ শোনা এবং পড়তে শেখার জন্য। আর ইংরেজি শেখার জন্য রাখলেন একজন শিক্ষিকা। এভাবে কিছু দিনের মধ্যে কানন নিজেরই উদ্যোগে নিজেকে গড়েপিটে তৈরি করে নিলেন। মায়ের কাছে পাওয়া শিক্ষা, জীবনের তেতো অভিজ্ঞতা এবং অর্জিত শিক্ষা মিলিয়ে তৈরি হল কাননের বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব।
সে আমলে কন্ট্রাক্ট শেষ না হলে কোন আর্টিস্ট এক স্টুডিও ছেড়ে অন্য স্টুডিওতে যোগ দিতে পারতেন না। এর অন্যথা হলে মামলা-মোকদ্দমার অন্ত থাকত না। এই সুযোগটাই নিত কিছু নারীলোভী নায়ক ও পরিচালক। তাদের লালসা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে কাজ বজায় রাখাটাও ছিল এক অমানুষিক সংগ্রাম! লালসা চরিতার্থ করতে না-পেরে নানান ছুতোয় তাঁকে অপমান, তাঁর অভিনয়ের মুড নষ্ট করে দেওয়ার কারসাজি দিনের পর দিন চলল। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে, পেটের দায় না থাকলে আর সিনেমাকে ভালো না বাসলে কানন হয়তো অভিনয় জীবন ছেড়েই দিতেন! এরইমধ্যে পরিচালক জ্যোতিষ বন্দোপাধ্যায় তাঁর অভিনয়ের শিক্ষাগুরু, শ্রদ্ধেয়; তিনিও একদিন অন্যায় করে বসলেন। ১৯৩১ সাল, কানন ও জ্যোতিষ দুজনেরই প্রথম সবাক ছবি, 'জোরবরাত'। এই ছবির একটি দৃশ্যে নায়ক জয়নারায়ণ মুখার্জি যে নায়িকা কানন দেবীকে ইংরেজি ছবির কায়দায় জড়িয়ে ধরে চুমু খাবেন, এটা কাননকে কেউ জানালেন না। এমনকি রিহার্সালেও সেটি করা হল না। টেকের সময় করা হল। তখন অতর্কিত এই ব্যাপারটি ঘটতে দেখে অপ্রস্তুত কানন নায়ককে ঠেলে সরিয়ে দিলেন। তাতে শটটি হল বটে, কিন্তু ছবিতে ব্যবহার করা গেল না। তবুও এই প্রবঞ্চনায় অভিনেত্রী হিসেবে ও একজন মেয়ে হিসেবে বড় অপমান বোধ করলেন কানন। তাই তাঁর বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব দিয়ে প্রতিবাদ করতে ছাড়লেন না। জ্যোতিষ অবশ্য সাফাই দিয়ে বললেন যে, এটা একটা এক্সপেরিমেন্ট, বললে কানন রাজি হতেন না। তাই না বলেই করা! এই বাজে যুক্তিতে ক্ষত বাড়ল, প্রলেপ পড়ল না।
কানন নিজে একজন শিল্পী হিসেবে যেভাবে দিনের পর দিন অপমানিত হয়েছেন, উপেক্ষিত হয়েছেন, মানসিক অত্যাচারের শিকার হয়েছেন; স্টুডিও সিস্টেমের সেই গড্ডলিকার গতি রোধ করতেই তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থা, 'শ্রীমতী পিকচার্স'। এই নামের পেছনে একটি অনুষঙ্গ আছে। নিউ থিয়েটার্স-এর 'বিদ্যাপতি' ছবিতে তাঁর চরিত্রটির নাম ছিল, 'অনুরাধা'। সেই থেকে সহ-অভিনেতা কৃষ্ণচন্দ্র দে তাঁকে স্নেহের বশে, 'রাধে' এবং পি এন রায় ডাকতেন, 'শ্রীমতী'। দুজনের অকৃত্রিম স্নেহকেই স্মরণে রাখতে এমন নাম। প্রথমে ছবি পরিচালনার ভার ছিল 'সব্যসাচী' গোষ্ঠীর ওপর। এই গোষ্ঠীতে ছিলেন অজয় কর, তরুণ মজুমদারের মতো পরবর্তীকালের স্বয়ংসম্পূর্ণ সৃষ্টিশীল পরিচালকেরা। অভিনেতা-অভিনেত্রী ও কলাকুশলীদের টাকাপয়সা ঠিকমতো দেওয়া, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পুরো গল্প শোনানো, তাঁদের মতামত নেওয়া, অভিনয়ে ও পরিচালনায় স্বাধীনতা দেওয়া, ভালো কাজ করার জন্য যা যা দরকার--সেই পরিবেশই কানন তৈরি করলেন 'শ্রীমতী পিকচার্স'-এ; যা প্রায় অন্যত্র দেখাই যেত না।
শুধু তাই নয়, দুঃস্থশিল্পীদের সাহায্যের জন্য শুধুমাত্র অভিনেত্রীদের নিয়ে জোট বাঁধলেন, গড়ে তুললেন, 'মহিলা শিল্পীসংঘ'। আসলে, এককালের এক খ্যাতনামা অভিনেত্রীকে অভাবের তাড়নায় ঘোমটায় মুখ ঢেকে ভিক্ষে করতে দেখে, এভাবে অবহেলিত শিল্পীদের পাশে দাঁড়াতেই তাঁর এই উদ্যোগ। নাটক করে টাকা তুলে অভিনেতা-অভিনেত্রী-সাংবাদিকদের উৎসাহে-দানে সেদিন এই উদ্যোগ রূপ পেয়েছিল এক আন্দোলনের।
লিঙ্গভেদ বাদ দিয়ে 'পৌরুষ' যদি হয় শিরদাঁড়া সোজা করে নিজেকে নিজে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নাম, তাহলে বলতে হয়, কানন দেবীর মধ্যে সেই 'পৌরুষ' ছিল। তিনি শুধু নিজের ভালোটুকুর জন্যই লড়াই করেননি, অন্যের ভালোর কথাও ভেবেছেন। 'মুক্তি', 'পরিচয়', 'শেষ উত্তর'-এর সফল নায়িকাটির ইতিবৃত্ত শুরু হয় একটি একা মেয়ের কঠিন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে; শেষ হয় একা এবং কয়েকজনে।
তথ্যঋণ: সবারে আমি নমি- কানন দেবী
সোনার দাগ- গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ