গ্রামোফোন কোম্পানির প্রথম ভারতীয় শিল্পী তিনি

                              সময়টা ১৮৭৩-এর ২৬ জুন, উত্তরপ্রদেশের আজমগঢ়ে জন্ম হলো এঞ্জেলিনা  ইয়েয়ার্ডের৷ নামটা অচেনা লাগছে ??? লাগারই  কথা। কিন্তু জানিয়ে রাখি ১৯০২ সালে প্রথম এই   ভারতীয় শিল্পীর রেকর্ড বের করল গ্রামাফোন কোম্পানি  একে বিদেশী নাম, তার উপর ভারতীয় !!! রহস্য!!! সেই রহস্য উন্মোচন করবো এবার।

                      এই এঞ্জেলিনা ইয়েয়ার্ডের দাদু ছিলেন ব্রিটিশ,  দিদিমা ভারতীয়৷ তাঁর মা  ভিক্টোরিয়ার ছোট থেকেই হিন্দুস্তানি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, কত্থক‚ ভারতীয়  ধ্রপদী শিল্পকলায় ছিল অনায়াস  বিচরণ৷ খুবই অল্পবয়েসেই ভিক্টোরিয়া এক জনৈক আর্মেনিয়ান ইহুদি উইলিয়াম ইওয়ার্ডের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে  বিবাহ বন্ধনে  আবদ্ধ হন৷ ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুন জন্ম নিল একমাত্র মেয়ে এঞ্জেলিনা ইয়েওয়ার্ড৷ ইতিমধ্যেই ভিক্টোরিয়া খুরশেদ আলমের সাথে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়ান। ফলে  কিছুদিনের মধ্যেই সম্পর্কে  ধরলো চিড়, ফলত এই বিবাহ সুখের হলোনা।

                                বিচ্ছেদের পরে প্রণয়ী খুরশেদ আলমকে বিবাহ করে ভিক্টোরিয়া ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন, নাম হলো মালাক জান! সাধের কন্যা এঞ্জেলিনা পরিচিত হলেন গওহর জান নামে  এই নামটা বেশ পরিচিত।  কিন্তু   ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে  ভিক্টোরিয়া ওরফে মালাক জানের এ বিয়েও কিন্তু  টিকলো না ।

                              ক্রমাগত বৈবাহিক সম্পর্কে ঘা খেয়ে, প্রত্যাখ্যাত হয়ে নৃত্য-গীতের জগতে প্রবেশ করলেন মালাক জান পাকাপাকি ভাবে এলেন কলকাতায়, গজল, ঠুমরি শেখা  শুরু হলো। মজলিস আলো করে গান গাইতেন মালাক আর মায়ের পাশে বসে তাল মেলাতেন ছোট্ট  গওহর। সংগীতের আকাশে ছড়িয়ে পড়লো তাঁর সাঙ্গীতিক  প্রতিভার বিচ্ছুরণ। কিশোরী গওহর প্রথম অনুষ্ঠান করেন ১৮৮৭ সালে দ্বারভাঙার মহারাজের আমন্ত্রণে৷ হয়ে গেলেন রাজার সভাশিল্পী৷

                          কিন্তু  তিনি খানিক  স্বাচ্ছন্দ্যের  অভাব বোধ করছিলেন। তাই  আবার স্বাধীন ভাবে   মেহেফিল শুরু করলেন৷ এবার এলো সেই মাহেন্দ্র ক্ষণ - ১৯০২ সালে প্রথম গ্রামোফোন কোম্পানির ফ্রেড গেইসবার্গের তত্ত্বাবধানে গান রেকর্ড করলেন গওহর৷ আরো আশ্চর্যের এই প্রথম কোনো ভারতীয় শিল্পীর রেকর্ড বের করল গ্রামাফোন কোম্পানি৷ এরপরেই এ দেশে বিখ্যাত হয়ে ওঠে গ্রামোফোন কোম্পানি৷  কিন্তু ইতিমধ্যেই মায়ের মৃত্যু তাঁকে গভীর শোকাচ্ছন্ন করে তোলে। যাই হোক১৯০২ থেকে ১৯২০ অবধি ১০টি ভাষায় অজস্র গান রেকর্ড হয়েছে তাঁর৷ তখন কলের গান মানেই গওহর জান আর প্রতিটি গান রেকর্ডের শেষে  তিনি বলতেন ..’মাই_নেম_ইজ_গওহর_জান

                      গওহর জানকে কোটিপতি বললেও কম বলা হয়। একরাতের  মেহেফিলে  তাঁর নজরানা ছিল সেই আমলে এক থেকে তিন হাজার টাকা, রেকর্ডিং পিছু পেতেন তিন হাজার টাকা৷  যেমন উপার্জন করেছেন তেমন  জলের মতো অপ্রয়োজনীয় শুধু সখ মেটাতে খরচও করতেন , খানিক খামখেয়ালিও ছিলেন।  শোনা যায় পোষা বিড়ালের বিয়ে দিতে বিশ শতকের গোড়ায় খরচ করেছিলেন বারোশো টাকা ৷ 

                       অর্থ, প্রতিপত্তি, বৈভব সব থাকলেও শান্তি পান নি সেভাবে।  এমনকি শান্তির খোঁজে  বয়সে অনেক ছোট তবলা বাদক  সৈয়দ আব্বাসকে  বিয়ে করে এক্কেবারে অশান্তির অতলে তলিয়ে যান। তার জন্যই সর্বশান্ত হন তিনি। তাঁর বেশিরভাগ টাকা হয় আত্মসাৎ করেছে‚ নয়তো নয়ছয় করে ফেলেছে গুণধর স্বামী ৷ বিয়ে ভাঙল, চললো মামলা, গওহর জিতলেন বটে - ততদিনে তিনি  ফতুর হয়ে গিয়েছেন৷ হারিয়েছেন গান গাওয়ার ক্ষমতা।  রাজা কৃষ্ণ ওয়াদিয়া মহীশূর প্রাসাদে আশ্রয় দিলেন কিন্তু অনুষ্ঠান না করে অন্যের বদান্যতায় বাঁচার পাত্রী ছিলেন না তিনি ৷ মাত্র দেড় বছরের মধ্যেই ১৯৩০-এর ১৭ জানুয়ারি কপর্দক শূন্য অবস্থায় চোখ বুজলেন সুরের এই যাদুকরী, সমাপ্তি হলো  সুর সম্রাজ্ঞীর  বেগমের অধ্যায়ের।

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...