গুপ্তদের পতন ও শশাঙ্কের উত্থানের মধ্যবর্তী সময়ে বাংলায় বেশ কিছু স্বাধীন শাসকের উদ্ভব ঘটে। এছাড়া ছিলেন কনৌজের প্রভাকরবর্ধন, হর্ষবর্ধন, মৌখরি, আসামে ভাস্করবর্মা, দক্ষিণ ভারতে পুলকেশী ( দ্বিতীয়), এরা সকলেই রাজনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে অবতীর্ণ হন। এমন সময় বঙ্গে এক স্বাধীন সম্রাটের আবির্ভাব ঘটে যিনি এক স্বাধীন রাজ্য ও রাজধানী গড়ে তোলেন এবং নিজের রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটান স্বমহিমায়। তিনি শশাঙ্ক - ঐতিহাসিকভাবে বাংলার স্বীকৃত প্রথম সম্রাট। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে বঙ্গদেশের ছোটো ছোটো রাজ্যকে একত্রিত করে তিনি গড়ে তুলেছিলেন গৌড় রাজ্য। সিংহাসনে আরোহণ করে ‘বঙ্গাব্দ’ এর সূচনা করেছিলেন তিনি।
ইতিহাসবিদদের মতানুযায়ী, আনুমানিক ৫৯০ থেকে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি রাজ্ত্ব করেছিলেন। শশাঙ্কের রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ বা কানসোনা। অর্থাৎ, কর্ণসুবর্ণ হয়ে উঠেছিল স্বাধীন ঐক্যবদ্ধ বাংলার প্রথম রাজধানী। এখনকার মুর্শিদাবাদ জেলার রাজবাড়িডাঙ্গার (রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের প্রত্নস্থল অথবা আধুনিক রাঙ্গামাটি) সন্নিকটে চিরুটি রেল স্টেশনের কাছে কানসোনা গ্রামই প্রাচীন যুগের কর্ণসুবর্ণ। অনুমিত হয় যে, তিনি রোহতাসগড়ের মহাসামন্ত হিসেবে কর্ণসুবর্ণের গৌড় রাজার অধীনে কিছুদিন রাজ্য শাসন করেন। কর্ণসুবর্ণের গৌড় রাজা ছিলেন সম্ভবত মৌখরী বংশের প্রতিনিধি। শশাঙ্ক ভারতের বিভিন্ন অংশে তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব সম্প্রসারণের উদ্যোগী হলে তাঁর প্রথম কাজ হয় মৌখরীদের দৃঢ নিয়ন্ত্রণ থেকে মগধ মুক্ত করা। তাঁর ৮ম ও ১০ম রাজ্যবর্ষে প্রকাশিত দুটি লেখ পাওয়া গেছে মেদিনীপুর থেকে এবং তারিখবিহীন অপর একটি লেখ খড়গপুরের নিকট এগ্রা হতে আবিষ্কৃত হয়েছে। এছাড়া শশাঙ্কের অধীনস্থ গঞ্জামের (উড়িষ্যা) রাজা মাধববর্মার তাম্রশাসন (৬১৯ খ্রিষ্টাব্দের), হর্ষবর্ধনের বাঁশখেরা ও মধুবন তাম্রশাসন এবং কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মনের নিধানপুর তাম্রশাসন থেকে তাঁর সম্পর্কে জানা যায়। শশাঙ্কের উৎকীর্ণ স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রাও পাওয়া গেছে। রোহতাসগড়ে প্রাপ্ত সিলের ছাঁচে লিখিত ‘শ্রী মহাসামন্ত শশাঙ্ক’, বাণভট্টের সমসাময়িক সাহিত্য উপকরণ, চৈনিক তীর্থযাত্রী হিউয়েন-সাং এর বিবরণ এবং বৌদ্ধ গ্রন্থ আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প শশাঙ্কের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। আশ্চর্যের ব্যাপার এই, স্বাধীন বাংলার প্রথম রাজধানী যেমন মুর্শিদাবাদে, তেমনি, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের রাজধানীও ছিল এই জেলাতেই।
চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন-সাঙ এর বর্ণনায় কর্ণসুবর্ণ নগরী ‘কিলোনসুফলন’ বলে উল্লিখিত। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী, বাসিন্দারা প্রচুর ধন সম্পদাধিকারী ছিলেন। আবহাওয়া আরামদায়ক হওয়ায় অঞ্চল ছিল শস্যশ্যামলা। একাধিক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল এখানে। যদিও হর্ষবর্ধনের পৃষ্ঠপোষকতা লাভকারী হিউয়েন-সাঙ শশাঙ্ক সম্পর্কে বলতে গিয়ে হর্ষের প্রতি গভীর পক্ষপাতিত্ব করেছেন। হর্ষবর্ধনের সভাকবি বাণভট্ট যেমন ‘গৌড়ভুজঙ্গ’ বা ‘গৌড়াধম’ ইত্যাদি ব্যবহার করে শশাঙ্কের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেন। কিন্তু কর্ণসুবর্ণের পাশেই ছিল বিখ্যাত রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার। এছাড়া নগরের ভিতর বেশ কিছু বৌদ্ধ মঠ ও মন্দির ছিল ।
মুর্শিদাবাদের রাঙামাটি গ্রামের রাজবাড়িডাঙায় খননকার্য চালিয়ে এক প্রাচীন বৌদ্ধ মঠের ধ্বংসস্তূপ পাওয়া গেছে। গবেষকদের মতে বলেন, এটাই ছিল রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার। তার সন্নিকটেই প্রতাপপুর গ্রামের রাক্ষসীডাঙা ঢিবিতে খননকার্য চালিয়েও পাওয়া গেছে প্রাচীন ইটের ভাঙাচোরা স্থাপত্য। স্থানীয় মানুষের কাছে তা রাজা কর্ণের প্রাসাদ নামেই অধিক পরিচিত।
গুপ্তযুগের পর এবং পাল যুগের আগে কর্ণসুবর্ণ হয়ে উঠেছিল পূর্বভারতের রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু। শশাঙ্কের রাজধানীকে দখল করতে চেয়েছিলেন থানেশ্বরের সম্রাট হর্ষবর্ধন, কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মন এবং আরও বেশ কিছু শাসক। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে মানবদেব কয়েক মাস গৌড় শাসন করেছিলেন। তারপর এক সময়ে হর্ষবর্ধন আর ভাস্করবর্মন গৌড় দখল করে সফলভাবে কর্ণসুবর্ণকে নিজেদের অধীনস্ত করেন। এর পর একাধিক রাজা এই অঞ্চলের দখল নিয়ে অরাজক পরিস্থিতির সূচনা করলে সমগ্র বাংলায় তার আঁচ ছড়ায়, শুরু হয় বাংলায় এক চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির, ঐতিহাসিক ভাষায় যা ‘মাৎসন্যায়’ নামে খ্যাত। যে খ্যাতির শীর্ষে শশাঙ্ক ঐকান্তিক প্রয়াসে বাংলাকে নিয়ে যায় তার মৃত্যুর পর তা কিছুটা হলেও ম্লান হয়।