কলকাতা পুলিশের প্রথম সরকারী গোয়েন্দা

সময়টা ১৮৬৮। দিনটা এপ্রিল মাসের প্রথম দিন।

ঘড়ির কাঁটা রাত দুটোর ঘর পেরিয়ে গিয়েছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাড়ি ফিরছেন এক পুলিশ অফিসার। রাস্তাটা মধ্য কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিট। এখন যার নাম রাজা রামমোহন রায় সরনী। প্রতিদিনই তিনি এই রাস্তা ধরে ফেরেন। গা ছমছমে আলোয় হঠাৎ ওঁর চোখে পড়ল রাস্তার পাশে বড় মাপের কিছু একটা  পড়ে রয়েছে। জিনিস তার কাছাকাছি যেতেই চমকে উঠলেন। দেখেন কাপড় মড়া জিনিসটা আর কিচ্ছু নয়। একটা লাশ! পরীক্ষা করে দেখলেন লাশটি এক মহিলার।

রক্তে ভেসে যাওয়া অবস্থা। পুলিশের দায়িত্বে আছেন তাই পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

হাতের টর্চ জ্বেলে লাশ পরীক্ষা করলেন ।চোখে পড়ল মহিলার বাঁ-হাতটি তার কোমরের নীচে মুচড়ে বেঁধে রাখা। আর ডান হাতটি ওপরে।

যে কেউ দেখে বলে দিতে পারে এটি কোনও সাধারন মৃত্যু হতেই পারে না। খুনের ঘটনা বুঝতে পারার প্রেই সেই পুলিশ অফিসার ফিরে গেলেন থানার পথে।

কাছেই থানা। সেই থানার বড়কর্তা তখন পুলিশ ইন্সপেক্টর রিচার্ড রিড। খবর আসতেই তৈরি হয়ে গেলেন। রাত তিনটের সময় পৌঁছলেন ঘটনাস্থলে।

রিড সাহেব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন সবটা। প্রাথমিক তদন্তে যা বুঝলেন দেহটি একজন খ্রীস্টান মহিলার।

ঘটনার সূত্র মেলানোর জন্য জেদ চেপে গেল তার। এদিকে ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই খবর ছড়িয়ে পড়ল কলকাতা শহরে। খবরের কাগজের লোকজনও জেনে গেল। খুনের ঘটনায় মহিলার মৃত্যু নিয়ে যা চিৎকার তার চেয়ে অনেক বেশি শোরগোল কলকাতা পুলিশের কাজ নিয়ে। শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা আলগা সে নিয়ে আঙ্গুল উঠতে লাগল।

ব্যপারটা ছড়াল পুলিশ কমিশনার পর্যন্ত। সেই পদে তখন হগ সাহেব। স্যার স্টুয়ার্ট হগ। যিনি আবার ক্লকাতা পুরসভার চেয়ারম্যানও। তাঁর নামেই  ধর্মতলার ‘হগ মার্কেট’।

অধস্থন পুলিশ কর্মীদের ওপর প্রচণ্ড রেগে গেলেন হগসাহেব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘটনার কিনারা করার নির্দেশ দিলেন।

ঘটনাটি যে অঞ্চলে ঘটে সেই অঞ্চল অর্থাৎ আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার দিয়িতবে ছিলেন রিচার্ড রিড। ভীষণ তৎপর হয়ে উঠলেন তিনি। নিহত মহিলার পরিচয় জানা গেলে রহস্যের কিনারা কিছুটা সুবিধা হবে। তাই মহিলার সমস্ত তথ্য বের করার জন্য কাজে লাগালেন ‘টিকটিকি’। খুব বেশি খুটে হল না। সুন্দরী, খ্রিস্টান মহিলা। পরিচয় বের করতে অসুবিধা হল না। জানা গেল মহিলার নাম ‘রোজ মেরি’। ব্যক্তিগত আক্রশ এবং অপরাধজগতের সঙ্গে জড়িত থাকার কারনেই খুন হতে হয় তাঁকে,

শহরে ঘটে যাওয়া নানা রকম ঘটনার মাঝে একটা খুনের ঘটনাকে বেশ ‘মামুলি’ চোখেই দেখা হয়। কিন্তু এই ঘটনা বড় পরিবর্তন এনেছিল তৎকালীন কলকাতার সামগ্রিক পুলিশি ব্যবস্থায়। অপরাধের তদন্ত এবং অপরাধী খুঁজে বের করার জন্য একটি বিশেগ বিভাগের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন কলকাতা পুলিশের কর্তারা।

১৮৬৮ সালের ২৮ নভেম্বর চালু হল কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। ‘রোজমেরি কান্ডের’ ঠিক ৬ মাসের মাথায়। পুলিশ কমিশনার হগ সাহেব বিভাগ চালুর আগে রীতিমত নোটিশ জারি করেছিলেন। এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি যখন ঘটে তখনও জন্ম হয়নি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের। পৃথিবী বিখ্যাত গোয়েন্দাকূল তখনও তাঁদের যাত্রা শুরু করেনি।

কলকাতা গোয়েন্দা বিভাগ জন্ম নেওয়ার আরও এক দশক পর স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড তৈরি হয়।

সম্ভবত কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগই বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো গোয়েন্দা বিভাগ যারা এখনও কাজ করে চলছে।

এই বিভাগের প্রথম প্রধান হিসাবে দায়িত্ব নেন এ. ইয়োনান। প্রথম শেণীর ইন্সপেক্টর হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন  আর ল্যাম্ব। এঁরা আগে কলকাতার পুলিশের অন্য বিভাগে যুক্ত ছিলেন।

 মাসিক ৬০ টাকা বেতনে  চার দারোগাকে এই বিভাগে বদলি করে নিয়ে আসা হয়। এছাড়াও নতুন বিভাগে ১০ জন হেড কনস্টেবল, ১০ জন সেকেন্ড ক্লাস কনস্টেবল এবং ১০ জন তৃতীয় শ্রেনীর কনস্টেবল নিয়োগ করা হল। কলকাতা শহর এবং অন্যান্য অঞ্চল থেকে। বদলি হয়ে আসা পুলিশ কর্মীদের বেতনও বেশি করা হল। আজকের ভাষায় ‘স্মার্টনেস’ আর ‘ইনটেলিজেন্স লেভেল’ দেখেই নির্বাচন করা হয় তাদের। এই বিভাগের চার দারোগার মধ্যে একজন ছিলেন রিচার্ড রিড। রোজ মেরি কান্ডের তদন্তকারী অফিসার।

বাঙালি যুবকদের মেধা ও সাহসের জন্য এই বিভাগে নিয়োগ করার ব্যাপারে খুব আগ্রহী ছিলেন ইংরেজ কর্তারা। ১৮৭৫ সালে বিভাগে বাঙালি কনস্টেবলের সংখ্যা ছিল ৩৩০ জন

১৮৭৩ সালে এই বিভাগকে ঢেলে সাজাবার নির্দেশ দিলেন হগ সাহেব। এই বিভাগ তখনও তাঁরই অধীনে।

পদন্নতি ঘটে রিচার্ড রিডের। এই বিভাগের রোজকার কাজকর্ম দেখাশোনার ভার তুলে দেওয়া হয় তাঁর হাতেই। পরে তিনি বিভাগের সুপারিনটেনডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কিন্তু ১৮৭৯ সালে আচমকাই পদত্যাগ করেন তিনি। ঠিক কী কারণে তিনি পদত্যাগ করলেন তার কোনও কারণ জানা যায়নি। পুলিশ কর্তার পদ থেকে সরে যাওয়ার পর তিনি এই কলকাতা শহরেরই বাসিন্দা হয়ে যান।

চাকরিজীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে পরে একটি বই লিখেছিলেন। বইটির নাম দেন ‘এভরি ম্যান হিজ ওন ডিটেকটিভ’। প্রকাশকাল ১৮৭৬

পরবর্তী সময়ে কলকাতা পুলিশের গোইয়েন্ডা বিভাগে অনেক পরিবর্তন হয়। অনেক নতুন বিভাগ, নতুন দায়িত্ব, প্রচুর পুলিশকর্মী। কিন্তু সব কিছুর উৎস রিচার্ড রিডের রোজ-মেরি খুনের কিনারা। সেই কারণে তিনি আজও কলকাতা পুলিশের প্রথম সরকারী গোয়েন্দা।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...