আজ আষাঢ়স্য প্রথম দিবস। আষাঢ়ের বারিষকে আজও স্বাগত জানায় কালিদাসের উচ্চারণ। বাংলার স্রষ্টারাও কম যাননি। জৈষ্ঠ্যের বৃষ্টি দিনে বসে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মেঘদূতে লিখেছেন, কবিবর, কবে কোন্ বিস্মৃত বরষে
কোন্ পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে
লিখেছিলে মেঘদূত!
এ যেন কালিদাসকেই প্রশ্ন করছেন রবীন্দ্রনাথ।
আবার সহজপাঠে রবি ঠাকুর লিখেছিলেন, 'বর্ষা নেমেছে। গর্মি আর নেই। থেকে থেকে মেঘের গর্জন আর বিদ্যুতের চমকানি চলছে। শিলং পর্বতে ঝর্নার জল বেড়ে উঠলো। কর্ণফুলি নদীতে বন্যা দেখা দিয়েছে। সর্ষে ক্ষেত ডুবিয়ে দিলে। দুর্গানাথের আঙিনায় জল উঠেছে। তার দর্মার বেড়া ভেঙে গেল। বেচারা গোরুগুলোর বড়ো দুর্গতি। এক হাঁটু পাঁকে দাঁড়িয়ে আছে। চাষীদের কাজকর্ম সব বন্ধ। ঘরে ঘরে সর্দি-কাশি। কর্তাবাবু বর্ষাতি প'রে চলেছেন। সঙ্গে তাঁর আর্দালি তুর্কি মিঞা।গর্ত সব ভ'রে গিয়ে ব্যাঙের বাসা হল। পাড়ার নর্দমাগুলো জলে ছাপিয়ে গেছে।' -কত সুন্দর বর্ষার ছবি এঁকে দিয়েছিলেন শিশু মনে।
বাঙালিকে গ্রাম বাংলার বর্ষা চিনিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়, পথের পাঁচালির দৃশ্যে ধরেছিলেন বাংলার বৃষ্টিকে। বাঙালির কাছে বর্ষা আজন্ম রোমান্টিক এক ঋতু, আবাদী ঋতু। হাজারও গানে, কবিতায় বর্ষাকে ছোঁয়ার চেষ্টা হলেও কালিদাসের পদ আজও বর্ষার আগমন ঘোষণা করে। মেঘদূতমের দ্বিতীয় শ্লোকেই রয়েছে বিখ্যাত পঙক্তিটি 'আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং'। মহাকবি কালিদাস তাঁর মেঘদূতম কাব্যে আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে বিরহী যক্ষ মেঘকে দূত করে কৈলাশে পাঠিয়েছিলেন তাঁর প্রিয়ার কাছে। বিরহ-প্রেমের ঋতু বর্ষায়, সেই বার্তাই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। বর্ষা কৃষকের কাছে প্রাণের ঋতু, মাটির উর্বরা শক্তির সঙ্গে সৃষ্টির মিল যে উপেক্ষা করা যায় না! নতুনের উদযাপন, সবুজ হয়ে ওঠা প্রকৃতি তো বর্ষার প্রতীক। বর্ষায় মন ক্রমাগত বাইরের পথে বেরিয়ে পড়তে চায়, কালিদাস যেন সেই আকাঙ্ক্ষাকেই জাগিয়ে দেয়।
কবিগুরুর ভাষায় বর্ষা ধরা দিয়েছে একই মন্তাজে,
'তোমার মন্ত্রবলে পাষাণ গলে, ফসল ফলে
মরু বহে আনে তোমার পায়ে ফুলের ডালা।'
তিনিই লিখছেন, 'আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে, আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে। এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি, পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি।' বা 'ঐ আসে ঐ ঘন গৌরবে নব যৌবন বরষা, শ্যাম গম্ভীর সরসা...।'
বর্ষাকে স্বাগত জানিয়ে নজরুল লিখেছিলেন, 'রিম্ঝিম্ রিম্ঝিম্ ঘন দেয়া বরষে। কাজরি নাচিয়া চল, পুর-নারী হরষে।' কবি জীবনানন্দ দাশ আষাঢ়কে বলেছেন 'ধ্যানমগ্ন বাউল-সুখের বাঁশি'। জল-যন্ত্রনা, কাদা, দু'কূল ছাপনো নদীর খেয়া পারাপার, রথের মেলার পাঁপড়, জিলিপি আর ইলিশ নিয়ে আষাঢ় আসে, আষাঢ় এমনভাবেই আসুক। আউশগ্রামে আবার আষাঢ় বরণ হয়, পয়লা বৈশাখের মতোই হলখাতা করা হয়। কৃষিকে প্রাধান্য দিয়েই এ আয়োজন। বহু দিন ধরেই তা চলে আসছে।
আষাঢ়ের সবথেকে বড় অনুষ্ঠান হল অম্বুবাচী। আম, কাঁঠাল পাকা গরমের পর ঝেঁপে বৃষ্টি নামে। প্রকৃতিও যেন ঋতুমতী হয়। গ্রামে গ্রামে শুরু হয় মনসার আরাধনা। জল শুকিয়ে রোদ উঠে বর্ষা কাটলেই দুগ্গাপুজো। তাই বর্ষা হল উৎসবের সূচনার ঋতু। এ সময় পুজো পান গঙ্গা। রথের দড়িতে টান পড়ে। কুমোর পাড়ায় দেবীর মূর্তি গড়া আরম্ভ হয়। এক তাল মাটি ত্রিনয়নী, জগৎজননীর রূপ নেন। বছরভর বিপদ থেকে রক্ষা পেতে বিপত্তারিণীর পুজো দেন মা-বৌ-ঝিয়েরা।