নদিয়ার তান্ত্রিক-পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ পনের শতকে দেবী কালিকাকে ধ্যানে পেলেন। কিন্তু, দেবীর কোন মূর্তি দেখতে পেলেন না। দেবী তাঁকে দেখা দিলেন নিছক নিরাকার ব্রহ্মরূপে। তবু আগমবাগীশের ভারি ইচ্ছে হল, মায়ের মূর্তি গড়ে পুজো করবেন। তন্ত্রে বা পুরাণে মায়ের নানান রূপের কথা আছে, কিন্তু কোন্ আদলে কার আদলে মাকে গড়বেন তিনি? সেই সাক্ষাৎরূপের কথা তো কোথাও নেই! শুধু আছে জগত্তারিণীর শক্তিরূপের অনুভব। ধ্যানে অনেক চেষ্টা করলেন, তবুও মা মূর্তিরূপে ধরা দিলেন না। ভক্ত বুঝলেন, মা তাঁকে ছলনা করছেন, মা তাঁর পরীক্ষা নিচ্ছেন। তাহলে এখন উপায়?
আগমবাগীশ জানেন, মায়ের চরণ ছাড়া তাঁর অন্য কোন গতি নেই। মা যতই মুখ ফিরিয়ে থাকুন না কেন, মায়ের চরণ তিনি ছাড়বেন না। কাজেই হত্যে দিলেন মায়ের থানে। তাঁর এমন আকুলতায়-আর্তিতে মা-ও এবার অধীরা হলেন। তবু দেখা দিলেন না। তবে, স্বপ্নে আগমবাগীশকে আদেশ দিলেন। বললেন যে, পরদিন ভোরে যে-নারীকে তিনি প্রথম দেখবেন, মায়ের রূপ তারই মতো। মায়ের আদেশ পেয়েই এক অনির্বচনীয় আনন্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। আর ঘুম এলো না। ভোর হতে তখনও দেরি আছে, কিন্তু আগমবাগীশ চাতকের মতো বসে রইলেন ভোরের অপেক্ষায়।
ভোর হল। আর ভোর হতে-না-হতেই মায়ের থান ছেড়ে আগমবাগীশ বেরিয়ে পড়লেন পথে। গ্রাম-গঞ্জের মানুষ বেশ ভোরেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। কিন্তু, কী আশ্চর্য, আজ পথে জনপ্রাণীটিও নেই! তিনি হাঁটতে হাঁটতে বামুনকায়েতদের পাড়া ছাড়িয়ে পৌঁছে গেলেন তথাকথিত অন্ত্যজদের পাড়ায়। আনমনে চলতে চলতে হঠাৎ একটা ছোট্ট 'থপাক' শব্দে সচকিত হয়ে থমকে গেলেন তিনি। 'থপাক', দেওয়ালে ঘুঁটে দেওয়ার শব্দ। ঘুঁটে দিচ্ছেন এক অন্ত্যজ নারী। এক পায়ে দাঁড়িয়ে, অন্য পা ভাঁজ করে দেওয়ালের দিকে তোলা। এক হাতে গোবরের তাল, আর এক হাত দেওয়ালের গায়ে ঘুঁটে দেওয়ার কাজে ব্যস্ত। কাজের ব্যস্ততার অবসরে কখন যেন ঘোমটা খসে গেছে, মাথাভরা আলুলায়িত কোঁকড়ানো চুল ছড়িয়ে পড়েছে পিঠময়। দেহ তাঁর ঘোর কৃষ্ণ। আগমবাগীশ মাতৃময়ী সেই নারীর দিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইলেন। এই তবে মা! তাঁর প্রাণের ঠাকুরাণী কালী-তারা-শ্যামা! চোখের সামনে চেতনাময়ীরূপে আবির্ভূতা! আগমবাগীশ যেন বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে দাঁড়িয়েই রইলেন, চোখভরে দেখতে লাগলেন কর্মময়ী সাক্ষাৎ জগজ্জননীকে।
মাটি থেকে গোবরের তাল সংগ্রহ করতে গিয়ে হঠাৎই সেই নারীর চোখ পড়ে গেল আগমবাগীশের ওপর। তাঁকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আর নিজের অসংবৃত অবস্থার কথা ভেবে তাঁর ভারি লজ্জা হল, সেই লজ্জায় তিনি জিভ কাটলেন। আর তক্ষুনি আগমবাগীশ যেন পেয়ে গেলেন মায়ের পরিপূর্ণ রূপ! একই অঙ্গে একদিকে মা তন্ত্রোক্ত লয়কারিণী কালরূপিনী করালী, হাতে খড়্গ, অসি-মুণ্ডধারিণী; অন্যদিকে বঙ্গসংসারের লজ্জাশীলা জননী, বরাভয়দাত্রী পালনকারিনী ধাত্রী। একসঙ্গে এমন বিপরীত ভাবের, এমন বিপরীতরূপের সমাবেশ আর কোন দেবীর রূপকল্পনাতেই নেই। সেখানে কালিকা একা ও অনন্যা। এই ভাবনা থেকেই এই রূপসজ্জাতেই আগমবাগীশ গড়ে তুললেন মা কালীর মাটির মূর্তি।
আগমবাগীশের এই কিংবদন্তি বা কাহিনি থেকে এটা একেবারে স্পষ্ট যে, আপাতচোখে যাঁকে সাধারণ মনে হয়, সেই নারীর মধ্যেই লুকিয়ে আছে মহামায়ার পূর্ণশক্তি। যাঁকে সমাজ অন্ত্যজ বলে দূরে ঠেলে দেয়, সেই অন্ত্যজের মধ্যেও তাঁর পূর্ণ-অবস্থান। নির্মল চোখে তাঁকে চিনে নিতে হয়, আকুতি নিয়ে তাঁকে খুঁজে নিতে হয়; যেমন করে আগমবাগীশ চিনে নিয়েছিলেন, খুঁজে নিয়েছিলেন মাকে।