পার্কস্ট্রিটের প্রথম বাড়ি

                               আধুনিকতা, আভিজাত্য ও পুরোনো কলকাতা,  ইতিহাস  সবের মেলবন্ধন এক ব্যস্ততম এলাকা এই  পার্কস্ট্রিট। আর সেখানেই ২০০ বছরের বেশি সময়ের ইতিহাস আজও স্বমহিমায়  দাঁড়িয়ে  আছে| শুধু  তাই নয় এই ঐতিহ্যশালী   ইতিহাস  শুধু কলকাতা নয়, গোটা ভারতের  গর্ব। সেই  ইতিহাস নিয়েই আজ কথা হোক।

                               ইতিহাসের কথা যখন উঠলো তখন প্রসঙ্গত বলা ভালো যে এই স্থানটি ইতিহাস চর্চার পীঠস্থান। মূলত  প্রাচ্য ইতিহাস গবেষণার অন্যতম উল্লেখযোগ্য স্থান। এবার বুঝতে সমস্যা নেই যে স্থানটি হলো পার্কস্ট্রিটের এক্কেবারে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা  এশিয়াটিক সোসাইটি।

                        

                                         এই এশিয়াটিক সোসাইটি কলকাতার একটি অগ্রণী গবেষণা সংস্থা।  আর এর সাথে যে  মানুষটির নাম জড়িয়ে তিনি হলেন উইলিয়াম  জোন্স।  অষ্টাদশ শতাব্দীর অন্তিম ভাগে উইলিয়াম জোন্স প্রাচ্য সম্বন্ধে গবেষণার উদ্দেশ্যে কলকাতা শহরে একটি উচ্চশিক্ষা সংস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগী হন, সেই  উদ্দেশ্যেই লন্ডনে পত্র পাঠান।  ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ জানুয়ারি তার পাঠানো একটি আমন্ত্রণপত্রে সাড়া দিয়ে বিচারপতি জন হাইড, জন কার্নাক, হেনরি ভ্যান্সিট্রাট, জন শোর, চার্লস উইল্কিন্স, ফ্রান্সিস গ্ল্যাডউইন, জোনাথন ডানকান প্রভৃতি তিরিশ জন ইউরোপীয়  বিদগ্ধ  ব্যক্তি কলকাতা শহরের পুরাতন সুপ্রিম কোর্ট ভবনের এক সভায় মিলিত হন। এই সভার সভাপতিত্ব করেন মুখ্য বিচারপতি স্যার রবার্ট চেম্বার্স। এই সভায় জোন্সের  পরিকল্পনা মতো দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয় ব্রিটিশ ভারতের তদানীন্তন রাজধানী কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে। ভারতের তদানীন্তন গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ছিলেন এই সংস্থার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ১৮০৮ সালে দক্ষিণ কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের একটি ভবনে সংস্থাটি স্থানান্তরিত হয়। ১৯৬৫ সালে এই ঐতিহাসিক ভবনটির পাশেই সোসাইটির দ্বিতীয় ভবনটির দ্বারোদ্ঘাটন করা হয়। বর্তমানে সোসাইটির একটি নিজস্ব গ্রন্থাগার ও নিজস্ব সংগ্রহালয়ও রয়েছে। এই গ্রন্থাগার ও সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে অনেক প্রাচীন পুঁথি, বইপত্র, তাম্রসনদ, মুদ্রা, প্রতিকৃতি, ছবি ও আবক্ষ মূর্তি। উল্লেখ্য, কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি সমজাতীয় সংস্থাগুলির মধ্যে প্রাচীনতম।

                               

                              প্রতিষ্ঠাকালেএশিয়াটিক সোসাইটির ইংরেজি নামের বানানটি ছিল Asiatick Society প্রসঙ্গত বলে রাখি এই নাম আর  তার বানান নিয়ে বিস্তর পর্ব চলে। ১৮২৫ সালে কোনওপ্রকার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই নামটির আধুনিকীকরণ করে ইংরেজি k অক্ষরটি বাদ দেওয়া হয়। এই সময় এশিয়াটিক সোসাইটির প্রাতিষ্ঠানিক নামকরণ হয় "The Asiatic Society"১৮৩২ সালে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় The Asiatic Society of Bengal ১৯৩৬ সালে পুণরায় নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় The Royal Asiatic Society of Bengalঅবশেষে ১৯৫১ সালের ১ জুলাই এশিয়াটিক সোসাইটির বর্তমান নামটি প্রবর্তিত হয়।

                             শুরুর দিন থেকেই এশিয়াটিক সোসাইটির মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রাচ্য ও ভারতের ইতিহাস, সংস্কৃতি চর্চা এবং সে নিয়ে গবেষণা করা। আজ যে জায়গায় মূল বাড়িটা দাঁড়িয়ে, সেখানে অবশ্য আসা ১৮০৮ সালে। তারপর থেকে নাম বেশ কয়েকবার বদলালেও, বাড়ি আর বদল হয়নি।

                          প্রতিষ্ঠার পর থেকে এশিয়াটিক সোসাইটিতে শুধু ইউরোপিয়রাই এর সদস্য পদ গ্রহণ করতে পারতেন। কিন্তু ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন সম্পাদক হোরেস হেম্যান উইলসনের উদ্যোগে ভারতীয়রা এই প্রতিষ্ঠানের সদস্য পদের অধিকারী হন। প্রসন্নকুমার ঠাকুর, দ্বারকানাথ ঠাকুর, রসময় দত্ত এবং রামকমল সেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম ভারতীয় সদস্য ছিলেন। ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে রাধাকান্ত দেবকে সদস্য হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে রামকমল সেন প্রথম ভারতীয় সম্পাদক এবং ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজেন্দ্রলাল মিত্র এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম ভারতীয় সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখন থেকে আজ অবধি, ভারতের শিক্ষা-সংস্কৃতির সঙ্গে প্রবলভাবে জড়িয়ে গেছে এই সংস্থা। শুধু তাই নয়, ইতিহাসের সাথে ঐতিহ্যের মেলবন্ধন আজও এই প্রতিষ্ঠানকে সম মর্যাদাশালী ও  অদ্বিতীয় করে  রেখেছে  । 

      

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...