ইংল্যান্ডের লর্ডস। টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হল এক বাঙালির। সৌরভ গাঙ্গুলি। সেই ম্যাচে শতরান করলেন তিনি। এরপরে ক্রিকেট জগতে তাঁর অবদান সবারই জানা। বাঙালির ক্রিকেট খেলার ইতিহাস প্রায় দেড়শ বছরের পুরনো। ১৮৭৭ সালে সাহেবদের হাত ধরে টেস্ট ক্রিকেট যখন শুরু হয় তারও কয়েক বছর আগে এক বাঙালির নেতৃত্বে এই বাংলায় ক্রিকেট খেলা শুরু হয়ে গেছে। সেই বাঙালি হলেন সারদারঞ্জন রায়।
১৮৭৭ সালের ১৫ মার্চ। অষ্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন। বিশ্বের ওই সময়কার দুই বনেদি ক্রিকেট দল অষ্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের মধ্যে প্রথম টেস্ট ম্যাচ শুরু হয়। তবে এর সাত বছর আগেই ১৮৭০ সালে মেলবোর্ন থেকে ৯ হাজার কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর মসুয়া গ্রামে ক্রিকেট ইতিহাসের সূচনা করেছিল পাঁচভাই। তাঁদের মধ্যে অন্যতম সারদারঞ্জন।
ক্রিকেট গবেষক ডঃ বরিয়া মজুমদারের মতে, ভারতে প্রথম ক্রিকেট খেলা শুরু করে পার্সিরা, মুম্বাইতে। তবে ক্রিকেটকে তাঁরা সীমাবদ্ধ করে রেখেছিল অভিজাত মানুষদের মধ্যে। সারদারঞ্জন রায়ই প্রথম মানুষ, যিনি ক্রিকেটকে গণ মানুষের কাছে নিয়ে এসেছিলেন। ক্রিকেটের জন্য যা যা করা দরকার, সবকিছুই করেছেন দুই হাত খুলে। তাই তাঁকে উপমহাদেশের ক্রিকেটের অগ্রদূত তো বটেই, উপমহাদেশের ক্রিকেটের জনক বললেও কিছু ভুল বলা হবে না।
১৮৬১ সালে বাংলাদেশের মসুয়ার বিখ্যাত রায় পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন সারদারঞ্জন রায়। কালীনাথ রায় ছিলেন তাঁর পিতা। তাঁরা পাঁচ ভাই আর তিন বোন। সারদারঞ্জন, কামদারঞ্জন, মুক্তিদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন, প্রমোদরঞ্জন। গিরিবালা, ষোড়শীবালা এবং মৃণালিনী হলেন তিন বোন।
জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী এবং তাঁর স্ত্রী রাজলক্ষ্মী দেবী নিঃসন্তান হওয়ায় পাঁচ বছরের কামদারঞ্জনকে দত্তক নেন। নাম রাখেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। বঙ্গ ক্রিকেটের পুরোধা সারদারঞ্জন রায় হলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বড়দা।
সারদারঞ্জন কিশোরগঞ্জের মাইনর স্কুলে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। তারপর ভর্তি হন ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে। ঢাকার একটি স্কুল থেকে প্রবেশিকা পেরিয়ে ঢাকা কলেজ। বি এ পরীক্ষায় ঢাকা অঞ্চলে প্রথম হয়েছিলেন। প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি নিয়ে কলকাতার সংস্কৃতে পড়া শুরু করেন। সেটি অসমাপ্ত রেখে গণিত শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হন।
১৮৮০ সালে সারদারঞ্জন ও তাঁর পাঁচ ভাই মিলে ঢাকা কলেজ ক্রিকেট ক্লাব গড়ে তোলেন। পরে তাঁরা কলকাতায় টাউন ক্লাব তৈরি করেন। দুই ক্ষেত্রে প্রধান হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সারদারঞ্জন রায়।
ভারতে তখন ক্রিকেট খেলা সীমাবদ্ধ ছিল ব্রিটিশ সাহেব এবং অভিজাতদের মধ্যে। তিনি সেই খেলাকে বাংলার সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। সঙ্গে পেলেন তাঁর ভাইদের। ঢাকা কলেজ ক্রিকেট ক্লাব এবং কলকাতার টাউন ক্লাব সেইসময় নিয়মিত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে খেলতে।
১৮৮৪ সালে কলকাতার ইডেন গার্ডেনে ক্যালকাটা প্রেসিডেন্সি ক্লাবের সঙ্গে এক খেলায় ঢাকা কলেজ জয়লাভ করে। তারপর একের পর এক জয়লাভ করে বেশ কয়েকটি খেলায়। বাংলায় জেলা ভিত্তিক ক্রিকেট খেলার প্রচলন তাঁরাই করেছিলেন। ক্রিকেট খেলার মাধ্যমে সারদারঞ্জন জাতীয়তাবাদী চেতনাকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছিলেন।
সেইসময় ক্রিকেট খেলার সরঞ্জাম ছিল বাংলার সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। ব্যাট-বল আসত বিলেত থেকে। বর্তমান পাকিস্তানের শিয়ালকোট হয়ে ভারতে এসে পৌঁছতো। স্বাভাবিকভাবেই এসব জিনিসের দাম ছিল আকাশ ছোঁয়া। বোম্বে ও দিল্লির অভিজাত লোকজনই তা কিনতে পারত।
কলকাতার যশোর রোডে ১৮৯৫ সালে "এস রায় অ্যান্ড কোম্পানি" নামে ক্রিকেট সামগ্রীর একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন সারদারঞ্জন রায়। শিয়ালকোট থেকে উইলো কাঠ এনে স্থানীয় আসবাব তৈরির কারিগরদের দিয়ে ব্যাট বানানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হত সারদারঞ্জনের কারখানায়। সঙ্গে ব্যাটও বানানো হত। ১৯০৬ সালে সারদারঞ্জনের কারখানায় তৈরি হওয়া "ব্যালান্সড ব্যাট" বিশেষ পুরস্কার পেয়েছিল।
সারদারঞ্জন রায় ক্রিকেটের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের বীজ বোপন করেছিলেন। শুধু তিনি নন তাঁর পরবর্তী প্রজন্মও ক্রিকেট খেলাকে সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এই উপমহাদেশে নারীদের ক্রিকেট খেলার সূচনাও তাঁদের পরিবারের হাত ধরেই হয়। ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত ইষ্ট বেঙ্গল ক্লাবের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্টও ছিলেন সারদারঞ্জন রায়।