ছবির জগতের রাজনীতি ও সত্যজিৎ রায়

‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫) সত্যজিতের প্রথম ছবি। তাঁর এই ছবি অসম্ভব সফল। এবং তা যে তাঁকে রাতারাতি বাংলাসহ বিশ্বের চলচ্চিত্র মহলে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিল—এ আমরা প্রায় সকলেই জানি। আমরা এও জানি যে, প্রথম থেকেই তাঁকে খুব অল্প বাজেটের মধ্যে বেশ কষ্ট করেই চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হয়েছে। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না যে, আত্মপ্রতিষ্ঠার পরও বিদেশের সম্মান অর্জন করে ভারতীয় সিনেমা তথা বাংলা সিনেমাকে গৌরবান্বিত করার পরও এই বাংলার মাটিতে তাঁকে ছবি তৈরি করতে গিয়ে ব্যক্তি-রাজনীতি ও গোষ্ঠী-রাজনীতির শিকার হতে হয়েছে বারে বারে। তারই একটি দৃষ্টান্ত নিয়ে এখন আমরা আলোচনা করবঃ

১৯৬৮ সাল। প্রথম ছবি তৈরির এক যুগ পরে সত্যজিৎ ছোটদের জন্য ছবি তৈরিতে আত্মনিয়োগ করলেন। ছবিটির নাম, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’। ইতোমধ্যে তিনি বড়দের জন্য চোদ্দটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি, একটি তথ্যচিত্র ও একটি শর্টফিল্ম তৈরি করে ফেলেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, চোদ্দটা বড়দের ছবি করার পর হঠাৎ এই সময় তিনি ছোটদের ছবির দিকে ঝুঁকলেন কেন?

‘এই সময়’ অর্থাৎ ১৯৬৮-তে এসেই যে সত্যজিৎ হঠাৎ করে ছোটদের জন্য ছবি করতে শুরু করে দিলেন, ব্যাপারটা এমন নয়। আসলে এই ছবির পরিকল্পনা তাঁর মাথায় প্রথম আসে, ১৯৬৩ সালে। কেননা, এই বছরই ছিল তাঁর শিশুসাহিত্যিক পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর জন্ম শতবর্ষ। তাই এ-বছর তিনি চেয়েছিলেন পিতামহের লেখা গল্পে ছবি তৈরি করে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে। এই সময়ই উপেন্দ্রকিশোরের লেখা গল্পগুলোর মধ্য থেকে ছবি তৈরির জন্য সত্যজিৎ ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’কেই নির্বাচিত করেছিলেন। কেননা, এই গল্পে গানবাজনা, ভুত, অলৌকিকতা, রাজারাজড়া, যুদ্ধ, রাজকন্যাপ্রাপ্তি প্রভৃতি ছোটদের মনোরঞ্জন ও ইচ্ছেপূরণের অসংখ্য উপাদান যেমন আছে, তেমনি আছে শিল্পিত সিনেমা তৈরির প্রভূত সম্ভাবনা।

পিতামহকে শ্রদ্ধা জানানো ছাড়াও এই ছবি নির্মাণের পিছনে ছিল পুত্র সন্দীপ রায়ের বায়নাও। সন্দীপ তখন নিতান্তই বালক। তিনি পিতার কাছে একদা আবদার করেছিলেন যে, শুধুই বড়দের না, তিনি যেন তাঁর মতো ছেলেদের জন্যও একটি ছবি তৈরি করেন। ফলে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ পিতা-পুত্র দু’জনেরই ইচ্ছেপূরণের ফসল

Satyajit-Ray-gugababa-poster mn

যাই হোক, ছবিটি ১৯৬৩-তে শুরু করা সম্ভব হয়নি। সম্ভব হল, ১৯৬৮’র শুরুতে। কেননা ছোটদের ছবি তৈরির জন্য তখনও সহজে প্রযোজক পাওয়া যেত না, এখনও পাওয়া যায় না। তবে এই সময় প্রযোজক অসীম দত্ত ও নেপাল দত্ত এগিয়ে এসেছিলেন। ব্যয় করেছিলেন চার লাখ টাকা। এই বাজেটেই সাত মাসের মধ্যেই ছবি তৈরি হয়ে মুক্তির জন্য একেবারে রেডি হয়ে গেল। কিন্তু বহু আগে থেকে মুক্তির দিন, হল সব ঠিকঠাক থাকা সত্ত্বেও নির্দিষ্ট দিনে ছবিটি কিছুতেই মুক্তি পেল না। কেন? বলছিঃ

আসলে, বাংলা চলচ্চিত্রের উন্নয়নের জন্য এই সময় বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি বিভাগের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সমিতি গড়ে তোলা হয়েছিল। এবং অচিরেই তাতে বেনোজল ঢুকে চলচ্চিত্রের উন্নয়ন দূরে থাক, নির্মাণের স্বাভাবিক পথটিকেই কণ্টকিত করতে শুরু করল। কানন দেবী, তপন সিংহ, তরুণ মজুমদারের মতো প্রযোজক-পরিচালকের সঙ্গে সত্যজিৎকেও এই সমিতির সদস্য করা হয়েছিল। কিন্তু উক্ত পরিস্থিতিতে তাঁদের মতো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা সমিতির সঙ্গে যুক্ত থাকা আর সমীচীন মনে করলেন না। প্রতিবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলেন। তাতে সমিতির সব রোষ গিয়ে পড়ল তাঁদের ওপর।

সমিতি ছেড়ে যাঁরা বেরিয়ে এলেন, সমিতি তাঁদের শ্যুটিং-এ ব্যাঘাত ঘটাতে লাগল নানাভাবে। সত্যজিতের ছবি যেহেতু মুক্তির অপেক্ষায় ছিল, তাই কলকাঠি নেড়ে তাঁর ছবির মুক্তি আটকে দিল। যে-সব হলের সঙ্গে মুক্তির জন্য চুক্তি হয়েছিল, সমিতির চাপের কাছে বাধ্য হয়ে সেই সব হল-মালিকেরা চুক্তি বাতিল করল। তৈরি হল এক উত্তেজনাময় পরিস্থিতি। রাস্তাঘাটে স্টুডিও-স্টুডিওতে বাংলা সিনেমাজগত দ্বিধা বিভক্ত হয়ে গেল। একদল সমিতির পক্ষ নিয়ে অবরোধ বজায় রাখল, অন্যদল সত্যজিতের হয়ে প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে লাগল। এই অবস্থা চলল প্রায় দশ-এগার মাস। সত্যজিৎ হাল ছাড়লেন না। নত হলেন না। অনেক চিঠিচাপাটি, অনেক লড়াই শেষে মাথা উঁচু করেই তিনি ১৯৮৯ সালের ৮ মে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ মুক্ত করলেন। ছবিটি একই সঙ্গে মুক্তি পেল ‘মিনার’, ‘বিজলী’ ও ‘ছবিঘর’—তিনটি হলে।

মুক্তির পর দেখা গেল সমিতি হীন চক্রান্ত করতে পারে, চলচ্চিত্র জগতের কিছু মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে; কিন্তু দর্শককে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তার কোথায়! ছোট থেকে বড় সমস্ত বয়সের সমস্ত শ্রেণির দর্শক এই ছবিকে ভালোবাসায় অকুণ্ঠ প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন। ছবিটি ইতিহাস তৈরি করল। তিনটি হলেই টানা ১০২ সপ্তাহ চলল। করল সর্বকালের রেকর্ড। কেননা, এর আগে ও পরে কোন বাংলা ছবিই টানা এতদিন কোন হলে চলেনি।ছবিটি যে শুধু টানা চলার রেকর্ড করল এমন নয়, সে বাঙালির রসনা-সংস্কৃতিতেও এক দারুণ ছাপ ফেলল। ক’দিনের প্রখ্যাত মিষ্টির দোকানে দোকানে পেল্লায় সাইজের ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ রাজভোগ পাওয়া যেতে লাগল। পুরো কলকাতা জুড়ে একেবারে হৈ হৈ রৈ রৈ কাণ্ড শুরু হয়ে গেল।  সে এক দারুণ ক্রেজ।

Satyajit-Ray-long-playing-record

শুধু তাই নয়, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ বাংলা ছায়াছবির গানের রেকর্ডের ক্ষেত্রেও এক অভিনব ঘটনা ঘটাল। তার গান, আবহ সঙ্গীত ও ভুতের রাজার সংলাপ সমেত লং প্লে রেকর্ড প্রকাশিত হল। এটিই বাংলা ছায়াছবির গানের প্রথম লং প্লে রেকর্ড।

সেদিন যে-ছবিটিকে আটকাতে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র হয়েছিল; সেই ছবিই বাঙালি জীবনের শিল্প, সংস্কৃতি ও বিনোদনে এক নতুন স্বাদ, নতুন উন্মাদনার স্বাক্ষর রেখেছিল। ঝামা ঘষে দিয়েছিল চক্রান্তকারীদের মুখে। আর আপোষহীন সত্যজিৎ প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, হীরে হীরেই, তার দ্যুতিকে কিছুতেই আড়াল করা যায় না!…

 

তথ্যঋণঃ ‘সকল কাঁটা ধন্য করে…’ (প্রবন্ধ)—সুদেষ্ণা বসু।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...