আদালত চত্বর। বাইরে আপাত-অপরাধীর পরিবারের মানুষজন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। ভিতরে এক উকিল ক্রমাগত প্রশ্নে জেরবার করে দিচ্ছেন তাঁর বিপরীত পক্ষের সাক্ষীদের। এই আইনজীবী অপরাধীর পক্ষের উকিল। প্রশ্ন-উত্তরের জটিলতা পেরিয়ে অবশেষে ন্যায় প্রতিষ্ঠা হবে, আশায় সকলেই। কিন্তু এ যে উলটপুরাণ!
রহস্যের পর্দা সরে যাওয়ার পর আবিষ্কৃত হল যাকে অপরাধী বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে সে আসলে নির্দোষ, নিরীহ একটি মানুষ। ষড়যন্ত্রের শিকার।
যে আইনজীবী প্রশ্ন করছিলেন তাঁর চোখে ফুটে উঠল এক অদ্ভুত প্রত্যয় আর আত্মবিশ্বাস। তিনি শুরু থেকেই জানতেন একজন নির্দোষ মানুষকে রীতিমতো চক্রান্ত করে বিপদে ফেলা হয়েছে। এমন এক উকিল-গোয়েন্দাই ছিলেন প্রসন্ন কুমার বসু।
নারায়ণ সান্যালের সৃষ্ট কাল্পনিক চরিত্র। প্লটটা কাল্পনিক হলেও সত্য অসত্যের এই লড়াই চিরন্তন। নারায়ণ সান্যালের রচিত গোয়েন্দা গল্পগুলোর বেশিরভাগেরই ভিত্তি এই সত্য আর অসত্যের লড়াই। তবে এক্ষেত্রে সাহিত্যের মূল আকর্ষণ আপাতদৃষ্টিতে যাকে অপরাধী বলে মনে করা হয়, তার অপরাধহীনতার প্রমাণ দিয়েই গল্প শেষ হয়।
প্রসন্ন কুমার বসু পেশায় একজন আইজীবী। তিনি তথাকথিত গোয়েন্দাদের মতো নন। উকিল হওয়ার সুবাদে তাঁর কাছে নানা কেস আসে। শুধুমাত্র কেস-হিস্ট্রি পর্যালোচনা করেই তিনি বুঝতে পারেন প্রকৃত অপরাধী কে! তার ভিত্তিতেই আদালতে রহস্যের উদ্ঘাটন করেন এবং নিরপরাধ মানুষকে শাস্তির হাত থেকে বাঁচান। প্রসন্নকুমার বসুর গল্পগুলো "কাঁটা সিরিজ" নামে পরিচিত।
১৯৬৮ সালে এই সিরিজের প্রথম প্রকাশিত গল্প "নাগচম্পা"। এখনো পর্যন্ত ২৫টি গল্প প্রকাশিত হয়েছে। ২০০১ সালে শেষ প্রকাশিত গল্পটি হল "হরিপদ কেরানির কাঁটা"। লেখক পাশ্চাত্যের সাহিত্যিক আর্ল স্ট্যানলি গার্ডনারের গোয়েন্দা সাহিত্যের দ্বারা ভীষণভাবেই প্রভাবিত হয়েছিলেন। প্রসন্ন কুমার বসু চরিত্র সৃষ্টির পিছনেও কাজ করেছিল সেই অনুপ্রেরণা। গার্ডনারের "পেরি ম্যাসন" সিরিজের ধাঁচেই এই গোয়েন্দা গল্পগুলো লেখা। স্ট্যানলি গার্ডনার নিজে একজন উকিল ছিলেন। নারায়ণ সান্যাল প্রসন্ন কুমার বসুকে পূর্বের "পেরি ম্যাসন" বলে উল্লেখ করেছিলেন।
প্রসন্ন কুমার বসু উকিল হওয়ার পাশাপাশি একজন চিন্তাবিদ ও ছিলেন। মানুষ হিসেবেও লেখক তাঁকে যথেষ্ট উদার এবং সহানুভূতিশীল রূপে পাঠকদের কাছে পরিচিত করেছেন। প্রসন্ন বাবুর স্ত্রী রানু একজন বিশেষভাবে চাহিদাসম্পন্ন মহিলা। তিনি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী এবং শিক্ষিত। স্বামীর কাজে নিজের বুদ্ধিমত্তা এবং চিন্তাধারা দিয়ে সাহায্য করেন।
তাঁদের মেয়ে সুবর্ণা ওরফে মিঠু একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন। প্রসন্ন কুমার বসুর পরিবারের সঙ্গে আরেকটি পরিবারের কথা উঠে এসেছে এই গল্পগুলোতে। কৌশিক এবং সুজাতার পরিবার। কৌশিক ও সুজাতা স্বামী-স্ত্রী। তাঁদের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থা আছে। নাম "সুকৌশলী"। গল্পে এই উকিল-গোয়েন্দা অনেক রহস্য সমাধানের ক্ষেত্রেই তাঁদের সাহায্য নিয়েছেন।
নারায়ণ সান্যালের গোয়েন্দা কাহিনীগুলো অন্য গোয়েন্দা কাহিনীর থেকে অনেকটাই আলাদা। এখানে গোয়েন্দা যেহেতু কলকাতা হাইকোর্টের উকিল, তাই পেশার সূত্রেই তিনি রহস্যদের মুখোমুখি হন। তাই পাঠক এখানে কোনো মক্কেলের গোয়েন্দার কাছে আসা এবং তাঁর সাহায্য চাওয়া এই বিষয়টা মিস করতেই পারে। তবে একবার রহস্যের মুখোমুখি হলে তুখোড় বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায় এই উকিলের। এই সাহিত্যের গল্পগুলো যেন জীবনীশক্তির বার্তা। কোনো নিরপরাধ মানুষের জীবনে অপরাধ, অন্যায় প্রবেশ করলে সেই জীবন শেষ হয়ে যায় বলেই আমরা ধরে নিই। কিন্তু প্রসন্ন কুমার বসু প্রত্যেক ক্ষেত্রে নিরপরাধ মানুষদের বাঁচিয়ে তাঁদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দিয়ে জীবনের জয়গান গেয়েছেন।
নিজের সন্তানের মৃত্যও এই উকিলকে তাঁর কাজ থেকে দূরে রাখতে পারেনি। এমনকি তাঁর স্ত্রীও সন্তান-শোক ভুলে স্বামীর কাছে যথার্থ সঙ্গ দিয়েছেন। কোন দুঃখই যে জীবনকে থামিয়ে দিতে পারে না, এ সব যেন তারই প্রতীক। আমাদের সমাজেও অন্ধকার মুছে ফেলে আলোর বার্তা পৌঁছনোর গল্পই বলে নারায়ণ সান্যাল রচিত প্রসন্ন কুমার বসুর গোয়েন্দা গল্পগুলি।