আজ থেকে আগামী তিন দিন সমস্ত শাক্তপীঠ বন্ধ থাকবে। কারণ, শাস্ত্রমতে ও লোকবিশ্বাসে দেবী রজস্বলা হয়েছেন। কোথাও কোথাও নিত্যপুজো অবশ্য হবে, কিন্তু, পূজারী দেবীর দিকে ফিরেও চাইবেন না, ফুলও দেবেন না--এবং দেবীকে স্পর্শ করবেন না! আসলে, শুরু হয়েছে অম্বুবাচীর কাল। এই কাল স্থায়ী হবে তিনদিন। অম্বুবাচী প্রবৃত্তিতে শুরু, নিবৃত্তিতে শেষ। এই তিনদিন পৃথিবীও ঋতুমতী হন। বছরে একবার।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দেবী বা পৃথিবীর এই ঋতুভাবনার শুরু কখন ও কীভাবে হল? আসলে, সেই আদিম যুগে সংস্কৃতি-ভাবনার সূচনা থেকেই পৃথিবীকে আমরা মাতৃরূপে কল্পনা করেছি। নারীরূপে কল্পনা করেছি। তাই তার ঋতুকালের কথাও ভেবেছি। অম্বুবাচী পর্বের জন্মই হয়েছে এই ভাবনা থেকে। আদিম-পুরুষতন্ত্রের যুগ থেকেই ঋতুমতী নারীকে আমরা অশুচিজ্ঞানে দূরে সরিয়ে রেখেছি, কোন শুভকাজে তাঁকে অংশ নিতে দিইনি! এমনকি এ-ক'দিন তাঁকে দৈনন্দিন কাজ থেকেও দূরে সরিয়ে রেখেছি, তাঁর ছোঁয়া খাইনি, দেবমন্দিরে ঢুকতে দিইনি, তাঁকে সকলের থেকে একা ও চিহ্নিত করে আলাদা করে দিয়েছি--একশো বছর আগে পর্যন্তও এ-প্রথা প্রবলভাবে বজায় রেখেছি; কোথাও কোথাও আজও বজায় রাখতে আমরা দ্বিধা করিনি! পুরুষতন্ত্রের সেই নির্লজ্জ অশুচি ভাবনা থেকে পৃথিবীও ছাড় পাননি। তাই এই তিনটে দিন মাটিতে চাষের কাজ করা হয় না। আগে বেশিরভাগ মানুষই মাটিতে উনুন কেটে রান্না করতেন, কিন্তু, অশুচি পৃথিবীর গায়ের ছোঁয়ায় রান্না করলে সেও হয় অশুদ্ধ--তাই এই তিনটি দিনেই অরন্ধনের ঐতিহ্য! শুধুই ফলাহারের দিন।
অলৌকিকতা ও লৌকিকতার আবেগে সর্বপ্রথম মাতৃরূপে আমরা কল্পনা করেছি প্রকৃতি এবং পৃথিবীকে। তারপর এসেছে দেবী ভাবনা। তাঁরাও যুগপৎ মা ও নারী। অম্বুবাচী তাঁদেরও ঋতুর কাল। তাই এ-সময় তাঁদের পুজো হয়না, মন্দির বন্ধ থাকে। পুরুষের কাছে ভক্তি পেয়ে, মাতৃত্বের স্বাদ পেয়েও দেবীমা পুরুষের অশুচিভাবনা থেকে মুক্তি পান না! ভাবুন, যে পুরোহিত বা ভক্ত পুণ্যকামনায় দেবীর নিত্যপুজো করেন, তিনিও এ-ক'দিন অশুচি দেবীর মুখ দেখলে পাপ হবে ভেবে দেবীর মুখের দিকে তাকিয়েও দেখেন না! কী অনির্বচনীয় ভণ্ডামি, কী নিদারুণ কুনীতি--তাই না! আসলে, পুরুষতন্ত্রের এটাই ঐতিহ্য!
কালের স্রোতে কাল চলে যায়। সেই স্রোতের ধারায় পুরুষতান্ত্রিক ভাবনাজাত নারীকে দূরে সরিয়ে রাখার ত্রিদৈনিক ঐতিহ্য আজ নিছক ধরণীমায়ের বিশ্রাম আর ফলাহারের আনন্দময় উৎসব হয়ে উঠেছে। সভ্যতার প্রলেপ দিয়ে পুরুষতন্ত্রের হীনতাকে ঢাকার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে, হীনতার নেতিটিকে বাদ দিলে পৃথিবীর ঋতুভাবনার পেছনে একটি ইতিবাচক সুন্দর কাব্যিক ব্যঞ্জনাও অনায়াসে খুঁজে পাওয়া যায় : কালে কালে ঋতুস্নানের শেষে মানুষী যেমন আবার গর্ভিনী হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠেন, তেমনি পৃথিবীও যেন আষাঢ়-এর নব ধারাস্নান শেষে শস্যশালিনী হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠেন। বৃষ্টি-নির্ভর ও সেচ-সুবিধে-হীন কৃষিক্ষেত্র সেই আদিম-কৃষিযুগ থেকে আজও প্রায় অনাবাদি হয়েই পড়ে থাকে; এক ফসলি নাম পায়; একমাত্র বর্ষার জলেই শস্যশালিনী হওয়ার সুযোগ পায়। এভাবেই আষাঢ় ও অম্বুবাচী একসূত্রের কার্যকারণে বাঁধা পড়েছে। প্রাচীন অম্বুবাচীর প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির কাল আজ এভাবেই হয়ে উঠেছে সেই শস্য কামনায় আরাধনা ও অপেক্ষার কাল। আসলে, ক্রমবিবর্তিত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এও এক লীলা।