বঙ্কিমের প্রফুল্লকে ভবানী পাঠক শিখিয়েছিলেন অসি চালনা, নম্রভদ্র ভীতসন্ত্রস্ত প্রফুল্লকে তিনি তৈরি করেছিলেন দেবী চৌধুরাণী। তখন সে হয়ে উঠেছিল ইস্পাতের মেয়ে। এ যুগে কোনো ভবানী পাঠকের প্রয়োজন হয়নি, আজকের প্রফুল্ল থুড়ি ভবানী নিজেই নিজেকে তৈরি করে নিয়েছেন। ইতিহাস তৈরি করলেন ভবানী। হ্যাঁ, হয়তো টোকিও থেকে সাফল্য নিয়ে তিনি ফিরবেন না ঠিকই, তিনি ফিরবেন গর্ব নিয়ে।
তিনি ফিরবেন স্মৃতি নিয়ে, সোনালি স্বপ্নের স্মৃতি, কিন্তু কিছুটা অপ্রাপ্তির।
ওঁর নাম ভবানী, পুরো নাম চাদলবদা আনন্দ সুন্দরামণ ভবানী। এক অনন্য কৃতিত্বের অধিকারিণী হলেন ভবানী।
কথায় বলে না, যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে। তিনি আরো একটু এগিয়ে। রান্নাও করেন, চুলও বাঁধেন, আবার তরোয়ালও চালান। হ্যাঁ, তিনি এবারের টোকিও অলিম্পিকে ভারতের হয়ে অসি খেলায় অংশ নিয়েছেন এবং এই প্রথম কেউ ভারত থেকে অলিম্পিকে অসি খেলায় অংশ নিলেন।
ইংরেজিতে এই খেলার নাম ফেন্সিং, ভবানী করেন সেবর ফেন্সিং। এই উপমহাদেশের এক অসামান্য সেবর ফেন্সিং খেলোয়াড় হলেন আমাদের ভবানী। এই অংশগ্রহণই তাঁকে জিতিয়ে দিয়েছে। ১৩০ কোটির দেশে, এতদিন ধরে যা কেউ করতে পারেনি। তিনি তাই করেছেন, বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছেন, দেখো আমরাও পারি।
কিন্তু ভবানীর শুরুটা কীভাবে হল?
সে সত্যি সত্যিই এক রূপকথার গল্প! কোনো অংশেই রূপকথার চেয়ে কম কিছু নয়। ফেন্সিংয়ে ভবানীর আগমন হয়েছিল নাটকীয় ভাবেই। স্কুলে পড়ার সময় অন্য কোনো খেলায় ভর্তির জায়গা ছিল না, তাই অগত্যা ফেন্সিংয়ে নাম লিখিয়ে ফেললেন চেন্নাইয়ের মেয়ে ভবানী। চেন্নাইয়ের মুরুগা ধনুশকোটি গার্লস স্কুলের তাঁর শিক্ষিকারা তাঁকে জানিয়েছিলেন, ফেন্সিং খুবই ব্যয়সাপেক্ষ খেলা। কিন্তু তাতে কী? নেশা যে ততক্ষনে ভর করে ফেলেছে ভবানীকে, ভবানী পিছপা হননি।
২৭ আগস্ট, ১৯৯৩ সালে চেন্নাইয়ের একেবারে সাধারণ মধ্যবিত্ত এক পরিবারে ভবানীর জন্ম হয়। ভবানীর বাবা সি সুন্দরামণ পেশায় ছিলেন পুরোহিত, তাঁর মা একদম সাধারণ এক গৃহবধূ। কিন্তু মেয়ের স্বপ্নপূরণে এদের অদম্য লড়াই এদের অনন্য সাধারণ করে তুলেছে। মেয়ের তরোয়াল চালানোর স্বপ্নকে অক্ষত-অটুট রাখতে ঋণ নিয়েছিলেন তাঁর বাবা। নিজের গয়না বন্ধকও রেখেছিলেন তাঁর মা।
মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ভবানী, ছোটবেলায় ফেন্সিং খেলার জন্যে স্কুলে বাবার উপার্জন বাড়িয়ে বলেছিলেন। পাছে উপার্জন কম জানলে, সে যদি বাদ পড়ে যায়।আজ যখন সেই ভবানীর যাদুতে বিশ্ব মুগ্ধ, দেশ তাঁর প্রতীক্ষায় তাকিয়ে আছে, তখন ভবানীর বাবা দিকশূন্যপুরের বাসিন্দা। মেয়ের নাম অলিম্পিকের আসরে দেখে যেতে পারেননি ভবানীর বাবা, ২০১৯ সালেই তিনি প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু হাত ছেড়ে দেননি ভবানীর মা। যেমন করে এই ১১ বছরের ছোট্ট মেয়েটা মায়ের হাত ধরে রেখেছিল শক্ত করে, যেমন করে ভবানীর মা সব বাঁধা প্রতিবন্ধকতা থেকে মেয়েকে ঠেলে দিয়েছিলেন উপরে, তেমন করেই আজও তিনি ভবানীর পাশে অনড় দাঁড়িয়ে।
তরোয়াল বেশ দামি বলে, স্কুলে একসময় বাঁশের লাঠি দিয়ে অনুশীলন করতেন ভবানী। আর আজ তাঁর খেলার দিকে তাকিয়ে আছে গোটা দেশ।
মায়ের হাত ধরে ২০০৪ সালে চেন্নাইয়ের জওহরলাল নেহেরু স্টেডিয়ামে যেদিন প্রথম গিয়েছিল ভবানী সেদিন সে জানত না এখানেই তৈরি হবে তার আগামী জীবন। স্কুলে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার দৌলতে ফেন্সিং চালু হয়েছিল, বোধহয় ইতিহাসের এই সমাপতনের জন্যেই। তাঁর প্রথম কোচ পি বিশ্বনাথন, মাত্র ৩০ সেকেন্ড ভবানীর খেলা দেখেই তাঁকে নির্বাচন করেন। তারপর ১৭ বছরের অনুশীলন, নানান জায়গায়। এসেছে সাফল্য, এসেছে ব্যর্থতা, কিন্তু হার মানেননি ভবানী। উঠে দাঁড়িয়ে ফের লড়েছেন, সাফল্যে আত্মহারা হয়ে পড়েননি। বরং লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন। বিশ্বে এই মুহূর্তে তিনি ৪২-তম এবং ভারতে প্রথম।
যখন সবাই ঘুমাতো, তখন লড়তেন ভবানী। মাস্ক, ইলেকট্রিক স্যুট, শিল্ড, পরে তরোয়াল নিয়ে অনুশীলনে নেমে পড়তেন ভবানী। ঠিক যেন রবি ঠাকুরের বীর পুরুষ কবিতা, তবে এখানে খোকা মাকে না, বরং মা খুকিকে রক্ষা করতেন। অনেকেই বলতেন মেয়ে সন্তান, অস্ত্র চালনা! একি খেলা! নিরাপদ তো! তখন মা পাশে দাঁড়াতেন ভবানীর। সমালোচনার জবাব দিয়ে, ভরসা দিতেন মেয়েকে। ভোর সাড়ে পাঁচটায় অনুশীলনে যেতেন ভবানী, সেখানে থেকে স্কুল, সেখানে থেকে আবার স্টেডিয়ামে, কারণ সেই অনুশীলন। সবটাই হত গণপরিবহণে। এই অদম্য লড়াই আর ইচ্ছাশক্তিই, তাঁকে সফলতার দোরগোড়ায় এনে দাঁড় করিয়েদিয়েছে।
দশম শ্রেণির পঠনপাঠন শেষ করে কেরালার থ্যালাসেসির স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়ায় তিনি যোগদান করেন। কোচ সাগর লাগু তাঁকে আবিষ্কার করে, সাই-তে নিয়ে আসেন।
মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি তুরস্কের প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তিন মিনিট দেরী হওয়ার কারণে, তিনি ব্ল্যাক কার্ড পেয়েছিলেন।
২০০৯ সালে মালয়েশিয়ায় কমনওয়েলথ গেমসে ব্রোঞ্জ পদক জেতেন তিনি। পরের বছর ২০১০ সালে ফের আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতকে ব্রোঞ্জ পদক এনে দিয়েছিলেন তিনি।
তারপর থেকেই ধারাবাহিক ভাবে এশিয়ান গেমস ও কমনওয়েলথে, কখনো বিশ্বমঞ্চে, কখনো অনূর্ধ্ব-২৩-এ ২০১০, ২০১২, ২০১৪, ২০১৫-তে অসি চালনায় ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে লড়াই করেছেন ভবানী।
২০১৫ সালে প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেট অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড়ের নামে নামাঙ্কিত রাহুল দ্রাবিড় অ্যাথলিট মেন্টরশিপ প্রোগ্রামের জন্য 'গো স্পোর্টস ফাউন্ডেশন'-এর ১৫ জন অ্যাথলিটের মধ্যে ভবানীও নির্বাচিত হয়েছিলেন।
২০১২ সালের কমনওয়েলথ গেমসে একক ও দলগত বিভাগে একটি করে মোট, দুটি স্বর্ণপদক পেয়েছেন। ২০১৭ সালে আইসল্যান্ডের রেকিয়াভিকে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে ভবানী প্রথম ভারতীয় হিসেবে সেবর ফেন্সিং-এ আন্তর্জাতিক স্বর্ণপদক জিতে নিয়ে আসেন।
গত পাঁচ বছর ধরে ভবানী প্রখ্যাত ইতালীয় প্রশিক্ষক নিকোলা জ্যানোটির অধীনে অনুশীলন করেছেন।
দীর্ঘ লড়াইয়ের পরে, আজ সে অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করা ভারতের একমাত্র অসি খেলোয়াড়। এও কী কম গর্বের!
ভবানীর কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল, টোকিও-তে শুরুটাও সে দারুণ জয় দিয়েই করেছিল।
টোকিও অলিম্পিকে ফেন্সিং-এর প্রথম ম্যাচেই টিউনিশিয়ার নাদিয়া আজিজকে ১৫-৩ পয়েন্টে হারিয়ে বাজিমাৎ করেছিলেন আমাদের ভবানী। কিন্তু তারপর সামনে ছিল কঠিন চ্যালেঞ্জ, ৬৪-এর রাউন্ডে জয় অনায়াসে এলেও ৩২-এর রাউন্ড পেরোতে সামনে ছিল কঠিন চ্যালেঞ্জ। সামনে প্রতিপক্ষ ফ্রান্সের ম্যানন ব্রুনেটের কাছে হেরে গেলেন ভারতের ভবানী। স্বপ্নভঙ্গ হল ভারতের।
তাতে কী! সবে তো ২৮। আবার সেই সেদিনের লাজুক, আজকের পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চির মেয়েটি ৫০০ গ্রামের তরোয়াল আর ১২ কেজি হেলমেট নিয়ে, লড়াইতে নামবে।প্রতিপক্ষকে মাত করে দিয়ে, বাজাবে জাতীয় সংগীত। তেরঙ্গা উড়বে হাওয়ায়, হয়তো সেদিন টোকিওর বদলে অন্য কোনো মঞ্চ থাকবে। কিন্তু অপরিবর্তিত থাকবে এই একশো ত্রিশ কোটির প্রত্যাশা প্রতীক্ষা।সেবারেও প্রার্থনার নাম হবে ভবানী, আবার ভবানীর নামে এক হয়ে উঠবে কাঁথি থেকে মেঘালয়, কার্গিল থেকে ধনুশকোটি।