এক ছোট্ট মেয়ে। বাড়িতে সে পর্দানশীন। ইচ্ছে-মত কিছুই করার অনুমতি নেই। তার ইচ্ছেরা বন্দি থাকে মনের গোপন কুঠুরিতে। এই পৃথিবীকে ভাল করে চোখ মেলে দেখতেও পারে না সে। সর্বদা তাকে থাকতে হয় বোরখার আড়ালে। কিন্তু স্বপ্নেরা আড়াল মানে না। মনের ভেতরেই রঙিন পাখা মেলে উড়ে বেড়ায়। সেই মেয়েটারও এমনটাই হয়েছিল।
তারপর তার জীবনে এলো এক স্বপ্ন-পুরুষ। তার স্বামী। মেয়েটার যাবতীয় ইচ্ছেরা ডানা মেলে মুক্তি পেল। স্বপ্নেরা পেল মুক্ত আকাশ।
মেয়েটার কলমে তাই ছিল শুধুই মুক্তির বার্তা। তবে সে অনুভব করত শুধু তার কলমের মাধ্যমে সম্পূর্ণ সমাজকে কুসংস্কার মুক্ত করা যাবে না। সে স্বপ্ন দেখত এক জগতের। যেখানে নারী, পুরুষে থাকবে না কোন বিভেদ। ইউটোপিয়ার স্বপ্ন।
এই স্বপ্নই তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিল প্রথম নারীবাদী কল্পবিজ্ঞানের গল্প। যে গল্পে শুধুই ছিল নারী-মুক্তির বার্তা। মেয়েদের যাবতীয় লাঞ্ছনার জবাব ছিল সেই গল্পে।
গল্পের নাম 'সুলতানাজ ড্রিম'। লেখিকার নাম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন অর্থাৎ বেগম রোকেয়া।
বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ সালের ৯ই ডিসেম্বর, অবিভক্ত বাংলায়। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে ছিলেন। তবে পড়াশোনার প্রতি তাঁর অসীম আগ্রহ আর জেদ তাঁর শিক্ষার পথে কোন বাধাকে টিকতে দেয়নি।
তবে মূলত তাঁর স্বামী খানবাহাদুর সাখাওয়াত হোসেনের অনুপ্রেরণাতেই তিনি লিখেছিলেন তাঁর প্রথম ও শেষ কল্পবিজ্ঞানের কাহিনী ‘সুলতানাজ ড্রিম’। মূল বইটি ইংরেজিতে হলেও পরে তা বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছিল। সুলতানার স্বপ্ন।
কেমন ছিল সুলতানার স্বপ্ন?
এক অন্যরকম দেশ। নাম 'লেডিল্যান্ড'। পুরুষদের বিশেষ কোন প্রভাব নেই এই দেশে। পুরুষরা সাধারণত সংসারের কাজকর্ম সামলায়। তবে অবহেলিত নয় তারা। আসলে এখানে পুরষদের বিচক্ষণতা বা মেধা নেই। তাদের বক্তব্যকেও খুব একটা আমল দেওয়া হয় না।
লেডিল্যান্ডের নোঙর মহিলাদের হাতে। তাঁরা কিন্তু শুধুমাত্র সাংসারিক খুঁটিনাটি বিষয়ে নিজেদের মতামত প্রকাশ করে দায়ভার ঝেড়ে ফেলেন না। তাঁরা প্রত্যেকেই হয় বৈজ্ঞানিক নয়তো বিজ্ঞানমনস্ক মেধাবী।
লেডিল্যান্ডের জন্য বৈদ্যুতিক গাড়ি আবিষ্কার করেছেন তাঁরা। সেই গাড়ি চলে আকাশ পথে। ওই অঞ্চলের মেয়েদের চিন্তা-ভাবনাও আকাশের মতই মুক্ত।
এমনকি পরিবার ও কেরিয়ারের দড়ি-টানাটানি নেই। কারণ, অফিসে থাকতে হয় তো মাত্র দু’ঘন্টা। আসলে অত্যাধুনিক যন্তপাতির সাহায্যে চট-জলদি করে ফেলা যায় যে কোনো কাজ। এই সব যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেছেন লেডিল্যান্ডের মেয়েরা।
তাঁরা সৌরশক্তিকে মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারে। এই লেডিল্যান্ড কুসংস্কার-মুক্ত চিন্তা-ভাবনার অঞ্চল। এখানে মেয়েদের মস্তিষ্ক পুরুষদের তুলনায় উন্নত। তা বলে পুরুষদের কোন বক্তব্য নেই এমনটা নয়। কিন্তু প্রাধান্য মেয়েদেরই ।
এভাবেই নারী মুক্তির বার্তা দিতে চেয়েছিলেন বেগম রোকেয়া। তবে মজার কথা হল, এই গল্প তিনি লিখেছিলেন এক পুরুষের অনুপ্রেরণাতেই। পুরুষটি তাঁর স্বামী।
বাংলা সাহিত্যে এমন ভাবে কল্পবিজ্ঞানের গল্প আগে রচিত হয়নি।
আজ আমাদের সমাজ অনেকটা এগিয়েছে। দুঃস্বপ্নের মত অনেক কুসংস্কারই বিদায় নিয়েছে পৃথিবী থেকে। তাও সাম্য আজও অধরা।
বেগম রোকেয়ার নারীমুক্তির সেই স্বপ্নের জন্য প্রয়োজন আরও বৃহত্তর, কু-চিন্তা মুক্ত পৃথিবীর। কল্প-বিজ্ঞানের মত বিজ্ঞানসম্মত, অথচ দৃঢ় কোন হাত ধরেই হয়ত পৃথিবী একদিন সেই স্বপ্নের দোর-গোড়ায় পৌঁছবে।