ক্রমশ ম্লান চেনা পৃথিবীর ছবি। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই ভয়ের মুখ। শুনশান রাস্তা। ঘরের ভিতর সিঁটিয়ে মানুষ। নীরব প্রার্থনায় কেবল পরিত্রাণের পথ খোঁজা। সাম্প্রতিক করোনা আক্রান্ত পৃথিবীর এটাই ছবি। জারি আছে জীবন জিতে ফেরার দুর্নিবার লড়াই। মৃত্যুর করাল গ্রাস থেকে সভ্যতা টিকিয়ে রাখার লড়াই। খোঁজ চলছে অস্ত্রের।
এমন লড়াই মানুষ আগেও লড়েছে। তার সমস্ত অসহায় কান্না থেকে জন্ম নিয়েছে কথা, গান, কবিতা। কালো দিনের অন্ধকার দলিল হয়ে গিয়েছে অক্ষরের গর্ভে।
“The graves are deep enough to busy the dead on three levels, without delay without coffins.” কবরের মধ্যে কীভাবে রাখা হচ্ছে একের পর এক মৃতদেহ, তার ছবি উঠে এসেছে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্র্কেজের ‘ লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা’ উপন্যাসে। প্রথম প্রকাশ ১৯৮৫ তে। ভাষা স্প্যানিশ।
উপন্যাসের মূল বুনিয়াদ মার্র্কেজের বাবা- মার কাহিনী। কলেরায় একের পর এক মানুষ মারা যাচ্ছে। মৃত্যুর মিছিল। এক কবরেই চাপা দেওয়া হচ্ছে একাধিক শরীর। কবরের জায়গাও অপ্রতুল।
প্যারিস থেকে এক তরুণ চিকিৎসক এসেছেন আফ্রিকায়। নাম জুভেনাল আর্বিনো। আক্রান্তের মানুষকে চিকিৎসা করছেন। একদিকে মারীর দাপট অন্যদিকে প্রেম। যেন জীবন আঁকড়ে বেঁচে থাকা। ছত্রে ছত্রে লেখক যেন মনে করিয়ে দেন, বেঁচে থাকার কোনও ব্যাকরণ হয় না। তা আপন গতিতে চলে। উদ্দাম। অকপট তার বেগ। কোনও বেড় দিয়েই সে গতি আটকানো যায় না।
মহামারীর প্রেক্ষাপটে বিশ্ব সাহিত্যে আরও একটি বিখ্যাত উপন্যাস ফরাসী লেখক আলবেয়ার কামু’র ‘দ্য প্লেগ’। ১৯৪৭- এ লেখা। যদিও মূল বইতে রচনাকালটি সম্পূর্ণ ভাবে উল্লেখ করেননি লেখক।
আলজেরিয়ার বন্দর শহর ওরানে মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল প্লেগ। ঘরে ঘরে মৃত্যু। সেই শহরকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন লেখক। তাঁর দীর্ঘ গবেষণার ওপর গড়ে উঠেছে উপন্যাসের শরীর। ‘দ্য প্লেগ’ এর কেন্দ্রীয় চরিত্র মধ্যবয়সী ডা. রিও। একদিন সকালবেলা সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দেখলেন একটা ইঁদুর অদ্ভুত ভাবে মরে পড়ে রয়েছে চলার পথে। শহরের সেটাই ছিল মহামারীর প্রথম সূচনা। তারপর মারা যান ডাক্তারের প্রতিবেশী। অজানা জ্বরে। কিন্তু শহর কর্তৃপক্ষ বিষয়টি অস্বীকার করলেন। তাদের দাবি ওই ব্যক্তি স্বাভাবিক জ্বরে মারা গেছেন।পরবর্তী সময়ে বায়ুর গতিতে ছড়িয়ে পড়ল প্লেগ। অনেকটা করোনার মতোই।
একসময় পুরো শহরের সমস্ত মানুষকে বন্দী করে রাখা হল। শুরু হল মহামারীর বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই। ভয়ের শিকল শরীরে জড়িয়েও। আলোতে ফিরবেই জীবন। মাঝখানের দিনগুলো আলোয় ফেরার সংগ্রাম।
মার্কেজ এবং কামু দুজনেই তাঁদের লেখায় চূড়ান্ত আশাবাদের আশ্বাস দিয়েছেন। অন্ধকার দিয়ে আলোয় আস্থা। ভালোবাসায় তার প্রাণ ভোমরা লুকিয়ে। কান্না, আর্তনাদ ডুবে যায়। তবু জয় হয় চিরন্তন মানবতার। প্লেগ, কলেরা বা করোনা প্রেক্ষাপট যাই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত আশাবাদই মলম। সময়ের ক্ষতে প্রলেপ পড়বেই...শুধু লড়াই থেকে সরতে নেই...