কিছুতে টান পড়লেই বাবা আর ‘ভালো বাবা’ থাকে না

বাবা ঠিক মা নয়, মা যেমন নরম কোমল, উল্টোদিকে বাবা মানেই কঠিন, কঠোর, শক্ত চোয়াল। বাইরে বাইরে বেশি থাকেন। কথা বলতে হয় মেপেঝেপে, ভুলচুক হলে চোখ রাঙানি, বকা খাওয়ার ভয়। নিজেই নিজের মধ্যে একটা অদৃশ্য দেওয়াল তৈরি করে দেওয়া, যার ওপারে দাঁড়িয়ে বাবা। হ্যাঁ, তাঁর ভূমিকা তো তাই, সর্বদা সন্তানের সুরক্ষার জন্য অতন্দ্র প্রহরীর মতো অক্লান্ত দাড়িয়ে। পৃথিবীতে ভালো মায়ের উদাহরণ প্রচুর, কিন্তু ভালো বাবা হতে পারার দায় অনেক। মা হলেন এমন এক ব্যক্তি যার ভালো হবার পিছনে কোনও কারণ লাগে না, যাকে ভালোবাসার জন্য শর্ত প্রযোজ্য হয় না, কিন্তু বাবার ক্ষেত্রে হয়। চাহিদামত খাওয়া-দাওয়া, কাপড়-চোপড়, ভালো জায়গায় পড়াশোনা, জীবনে চলার ক্ষেত্রে যে কোনও কিছুতে টান পড়লেই বাবা আর ভালো বাবা থাকে না। বাবা যেন সমস্ত দায়-দায়িত্বের গুরুভার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক নিঃসঙ্গ সারথি, সন্তানদের হাত ধরে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়াই তার কর্তব্য। 'এটা দাও ওটা দাও, এটা কেন নেই?' এই সব অভিযোগ শুনতে শুনতে জেরবার হয়ে যায় যে মানুষটা সেই তো বাবা। সন্তানকে অবাধ স্বাধীনতা না দিলে ব্যাকডেটেড, আর অতিরিক্ত প্রশ্রয় দিয়ে অমানুষ হলে ব্যর্থ অভিভাবক। তার সাফল্য আর ব্যর্থতার চুলচেরা বিশ্লেষণ চলে অহরহ। বাবা হলেন সেই মানুষটা যাকে খুব সহজেই ব্যর্থতার তকমা এঁটে দেওয়া যায়। 'তুমি তো কিছুই করোনি আমাদের জন্য' বাবার কষ্টের টাকায় বড় হয়ে উঠে এই ব্যর্থতার দায় চাপিয়ে দিই আমরা অক্লেশে। তবুও অভিযোগ নেই, শুধু ভিতরে ভিতরে যন্ত্রণায় দগ্ধ হওয়া ছাড়া কোনও ভাষা থাকে না বাবার মুখে। 

'আঘাত পেলেও তার কষ্ট পাওয়া বারণ/ তিনি যে বাবা হয়তো এটাই তার কারণ'

জীবন সায়াহ্নে এসে সন্তানের থেকে প্রাপ্তির ঝুলি হিসাবে মায়ের জন্য যদি বা কিছু থাকে, বাবার জন্য তা প্রায় শূণ্য। কিন্তু বাবা কি এতটাই অবহেলার পাত্র? শুধুমাত্র সন্তানের জন্য যাকে সবকিছুই নির্দ্বিধায় ত্যাগ করতে হয়।। আদর-শাসন-বিশ্বস্ততার এক মূর্ত প্রতীক তিনি।

"মরিয়া বাবর অমর হয়েছে নাহি তার কোনো ক্ষয়/

পিতৃস্নেহের কাছে হয়েছে মরণের পরাজয়।"

বেশিরভাগ বাবা'ই ভালোবাসি শব্দটা বলতে জানেন না, শুধু করতে জানেন। তারা আজীবন তাদের ভাগের বিলাসিতার ভাগ দিয়ে স্ত্রী সন্তানকে ভালোবেসে যান। কথায় আছে পকেট খালি তবুও, বাবাকে নেই বলতে শুনিনি। আমি বাবার চাইতে, ধনী কাউকে দেখিনি। আমাদের ইচ্ছে পূরণের জন্য তার নিজের ইচ্ছেকে চাপা দিতে তিনি পিছপা হননি। তাই মানুষটার কাছে সন্তানের সুখটাই সবসময় বড়ো হয়ে উঠে। বাবা, এই শব্দটা শুনলেই মিশ্র এক অনুভূতির জন্ম নেয় মনের মধ্যে কিছুটা ভয়, কিছুটা ভালোবাসা, কিছুটা মনমালিন্য আর অনেকটা ভরসা। তবু বাবার হাত ধরে উঠে দাঁড়ানোর সৌভাগ্য সব সন্তানের হলেও,হাত ধরে উঠে দাঁড়ানোর সৌভাগ্য সব বাবার হয় না। সময়ের সাথে সাথে সেই ভরসার হাতটাও আলগা হয়ে যায়, মনের মধ্যে জমে থাকা ভালোবাসার গুটি পোকা যখন প্রজাপতি হয়ে উড়তে চায় তখন অজান্তেই ভরসাস্থলটা বদলে যায়। তারপর ধীরে ধীরে বাবার জায়গা নেয় বাবান, শুরু হয় আর এক পিতৃত্বের পথ চলা। এক পিতৃত্বের দায় নিতে গিয়ে নিজের পিতা হয় উপেক্ষিত। হয়তো পিতাদের এটাই ভবিতব্য। এই বঞ্চিত বাবাদের মর্যাদা দেবার জন্যেই শুরু হয় পিতৃ দিবস।

আমেরিকার ওয়াশিংটনের স্পোকান শহরে সোনোরা লুইস ডডের মা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। তখন ডডের বয়স ছিল ১৬ বছর। আর ডডের বাবা উইলিয়াম জ্যাকসন সবেমাত্র যুদ্ধ থেকে ফিরেছে। তারপর থেকে ডড দেখেছে তার বাবা ছয় ভাই- বোনকে মানুষ করার জন্য রাত দিন কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে। তাদের স্বার্থে সে আর বিবাহ করেনি। বাবা তাদেরকে মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি। যেন বাবাই তাদের মা। বাবাই ছিল তাদের সব কিছু। তাই পিতৃ দিবস ঘোষণার বিষয়টি  সোনারের চিন্তায় আসে ১৯১০ সালে। মা দিবসের মতো বাবাদের জন্যও একটি দিবস করা প্রয়োজন, যেখানে বাবাদের জন্য থাকবে হৃদয় নৈবেদ্যের ছোঁয়া। তাই দেশটির মন্ত্রীসভা জুন মাসের তৃতীয় রবিবারকে পিতৃ দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। তখন একটি স্থানীয় পত্রিকাও সেদিন ছুটি ঘোষণা করে এবং বিভিন্ন দোকানিরা বাবাদের জন্য নানা রকমের উপহার সামগ্রী সাজিয়ে রাখেন। শুরু হয় পিতৃ দিবস। 

জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বিশ্বের প্রায় ৭৪ টি দেশে পিতৃ দিবস পালিত হয়। মাতৃ দিবসের ধারণা থেকেই পরবর্তীতে মনে হয়, রাগ শাসন ও রাশভারী চেহারার আড়ালে এই মানুষটির কোমল হৃদয় তো মাতৃ হৃদয়ের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। তাই ১৯৭২ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন জাতীয়ভাবে পিতৃ দিবস পালনের রীতি চালু করেন। 

কিন্তু একজন পিতার কি কেবল একটা দিনই প্রাপ্য, তাদের প্রতিদিনের লড়াইকে মর্যাদা দেবার জন্য সন্তানদের কি কিছুই করার নেই? নেই বলেই হয়তো বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যাটা দিন দিন বেড়েই চলছে। তাই দিন পালন নয় দিনবদল হোক, নিঃস্বার্থ পিতার জীবন হোক সম্মানের। কারণ বাবার ভূমিকা তো জীবনে বলে শেষ করা যাবে না। একজন বাবা সূর্যের মতো, গরম হলেও তিনি না থাকলে চারিপাশে অন্ধকার হয়ে যায়। তাই আজকের দিনে সেই আলোর দিশারীর দিকে চেয়ে পথ চলি। পথ চলতে গিয়েও মনে প্রশ্ন জাগে বাবার পা কি অন্য সবার চেয়ে অনেক দ্রুত চলে? নইলে এতোটা পথ এত অল্প সময়ে কি করে এত শক্ত করে সব কিছু আগলে রাখেন বাবা। গাম্ভীর্য আর অনুশাসনের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা কোমল স্নেহময় রূপটি তো শিখিয়েছে কিভাবে পাড়ি দিতে হয় জীবনের অলিগলি আর আঁকাবাঁকা বন্ধুর পথ। বাবার জন্য আমাদের অনুভূতি প্রতিদিনকার, প্রতিটা মুহূর্তের। তিনি তো আমাদের নির্ভরতার আকাশ, নিঃসীম নিরাপত্তার চাদর। যা জড়িয়ে আমরা দিব্বি কাটিয়ে দিতে পারি গোটা একটা জীবন। যিনি কিনা নিজের ছোট ছোট স্বপ্নের গলা টিপে সন্তানের আগত স্বপ্ন কে বড়ো করে তোলেন। দায়িত্বের বেড়াজালে নিজেকে বন্দি করে খুঁজে দেন স্ত্রী-সন্তানের মুক্তির আনন্দ। বনস্পতির মত আগলে রাখেন, হয়তো বাবার ছায়া শেষ বিকেলের বট গাছের ছায়ার চাইতেও অনেক বড়ো। তাই তো সন্তানকে জীবনের সব উত্তাপ থেকে সামলে রাখেন। তাই বাবা শুধু একজন মানুষ নন, কেবল একটি সম্বোধন নয়, বাবার মাঝে জড়িয়ে আছে বিশালত্বের এক অদ্ভুত মায়াবী প্রকাশ।

 

        পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম পিতা হি পরম তপঃ

        পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রিয়ন্তে সর্ব দেবতা।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...