ভাল থাকুন 'ফুলেশ্বরী'

মেয়েটির জন্ম নদীয়ার নবদ্বীপে। ছিল সে যশোরের কোন এক জমিদার বংশের মেয়ে। কিন্তু বালিকা বয়সেই দুর্ভাগ্যের ছায়া পড়ল এসে তার উপর । সাত বছর বয়সেই পিতৃহীন হল ছোট্ট মেয়েটি। তবুও মা এবং ছোট ভাইকে আঁকড়ে ধরে বাবাকে হারানোর দুঃখ ভুলতে চেয়েছিল মেয়েটি। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার পিছু ছাড়ল না।

ছোট ছোট মেয়েরা যখন নয় দশ বছর বয়সে পুতুল নিয়ে খেলা করে তখন সে তার মাকে হারাল। বাধ্য হয়ে তাকে ভাই-সহ আশ্রয় নিতে হলো মামার বাড়িতে কিন্তু মামার অবস্থাও খুব বেশি ভাল ছিল না, তাই জন্য তাঁকে স্কুল ছাড়তে হলো। অতটুকু বয়স থেকেই তার সংগ্রামের জীবন শুরু। সে বুঝে গেল তাকে আজীবন লড়াই করতে হবে। কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে তাকে সাফল্য পেতে হবে সেই জেদটাও তার মধ্যে ছিল।

মেয়েটির জন্ম হয়েছিল ১৯৪১ সালে আর মামার সঙ্গে সে যখন দেশভাগ হবার পর ভারতে চলে এল ওপার বাংলা থেকে, তখন তার বয়স ষোল বছর, সালটা ১৯৫৭। কলকাতায় এসে মামা উঠলেন পাইকপাড়া অঞ্চলে একটি বস্তিতে। সেই মেয়েটিরও আশ্রয় জুটল সেখানেই। সেই ঘিঞ্জি বস্তিতে মেয়েটি একদিন দেখল যে সেখানকার কয়েকজন মেয়ে সিনেমাতে এক্সট্রার অভিনয় করে।

Sandhya-Roy1

সেই মেয়েটিও একদিন তার বান্ধবীদের সঙ্গে শুটিং দেখতে চলে গেল স্টুডিওতে এবং সেই এক্সট্রাদের মধ্যে সেও জায়গা পেয়ে গেল। ভাগ্যদেবী সেদিনই বোধহয় প্রসন্ন দৃষ্টিতে সেই মেয়ের দিকে তাকিয়েছিলেন। অন্যান্য এক্সট্রা মেয়েদের যেখানে ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করবার থাকে না সেখানে প্রথমদিনই তার ভাগ্যে জুটেছিল দুটি ডায়ালগ বলার সুযোগ।

দিব্যি বলে দিল সে। পারিশ্রমিক হিসেবে পেয়েছিল পাঁচটি টাকা এবং একটা মিষ্টির বাক্স যার মধ্যে ছিল একটা শিঙাড়া ও দুটো বা তিনটে মিষ্টি। প্রায় "না খেতে পাওয়া" অবস্থার মেয়েটি ভাবল "এরকম যদি কয়েকটা সুযোগ জোটে সিনেমায় মুখ দেখানোর তাহলে পেট ভরা খাবারটা অন্তত জুটে যাবে নিজের আর ভাইয়ের"... ছোট ভাই ছিল সেই মেয়েটির সঙ্গেই। একদিন এরকমই ছোটখাটো ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ খুঁজতে এসেছিল রাধা স্টুডিওতে। সেদিন বোধহয় কোন রোল জোটে নি।

স্টুডিওর বাইরে একটা দোকানে বসে মুড়ি খাচ্ছিল মেয়েটি। এমন সময় স্টুডিওর ভিতর থেকে একজন কর্মচারী এসে মেয়েটিকে বললেন "একবার ভিতরে এসো তো।" মেয়েটি গেল। এক বিখ্যাত পরিচালক তাকে ডেকেছেন। তাঁর নতুন ছবির জন্য নতুন মুখ খুঁজছেন তিনি। মেয়েটিকে দেখে, কথা বলে তাঁর পছন্দ হল। মেয়েটি সুযোগ পেয়ে গেল বিখ্যাত পরিচালক রাজেন তরফদারের ছবিতে অভিনয় করার।

ছবির নাম অন্তরীক্ষ, আর বাংলা সিনেমা পেয়ে গেল এক অসাধারণ অভিনেত্রীকে যে অভিনেত্রী তাঁর অভিনয় কুশলতায় দর্শককে মুগ্ধ করেছেন পরবর্তী তিরিশ বছর। সেই মেয়েটির তথা পরবর্তীতে সুবিখ্যাত অভিনেত্রীটির নাম সন্ধ্যা রায়... সুচিত্রা সেন, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, সুপ্রিয়া দেবীর মত দাপুটে অভিনেত্রীদের পাশাপাশি অভিনয় জগতে যিনি নিজের একটি স্বতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছিলেন। দাদার কীর্তি, বাঘিনী, মেঘমুক্তি, মনিহার এর মত জনপ্রিয় ছবিগুলো যাঁর অভিনয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

Sandhya-Roy2

পাশের বাড়ির মেয়েটি অথবা স্নেহময়ী বৌদি.... মিষ্টি প্রেমিকা অথবা স্বামী-সংসার নিয়ে সুখী স্ত্রী , নায়িকার সুন্দরী ছোটবোন অথবা জীবনযুদ্ধের সৈনিক... এই ভূমিকাগুলিতে সন্ধ্যা রায় ছাড়া কাউকে ভাবাই যায় না। একটু মনে করে দেখুন "ফুলেশ্বরী"কে অথবা "ঠগিনী" কে। রাজেন তরফদারের গঙ্গা ছবিতে তো সন্ধ্যা রায়ের অভিনয় ভোলার নয়।

"বাবা তারকনাথ" এর মত চূড়ান্ত বানিজ্যিক ছবিতেও তিনি যেমন একটু চড়া দাগের অভিনয়ে দর্শককে মাতিয়ে রাখেন তেমনি মুগ্ধতা ঘিরে ধরে আমাদের যখন সত্যজিৎ রায়ের অশনিসংকেত ছবিতে এক অন্য সন্ধ্যাকে দেখি। তরুন মজুমদারের বেশিরভাগ ছবিতেই অপরিহার্য ছিলেন সন্ধ্যা রায়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং বিশ্বজিৎ এর সঙ্গে জুটি বেঁধে বেশ কয়েকটি বানিজ্য সফল ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি।

বিশ্বজিৎ-এর সফল নায়ক হওয়ার ক্ষেত্রে সন্ধ্যা রায়ের অবদান কম নয়। তাদের সবথেকে সফল ছবি বাবা তারকনাথ হলেও আরো দুটি উল্লেখযোগ্য ছবি হল তরুণ মজুমদার পরিচালিত কুহেলি এবং শ্রীমান পৃথ্বীরাজ। এখানে ব্যক্তিগত ভাবে ভাল লাগা একটা ছবির নাম বলি? ছবিটির নাম "দ্বীপের নাম টিয়া রং"... সন্ধ্যা রায় যে কতটা দক্ষ অভিনেত্রী তার পরিচয় তিনি বারবার দিয়েছেন।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি তরুণ মজুমদারকে বিবাহ করেছিলেন। বর্ষীয়ান এই অভিনেত্রীর দীর্ঘ জীবন কামনা করি আমরা, তাঁর গুণমুগ্ধ দর্শক ভক্তরা। সুস্থ থাকুন, ভাল থাকুন, দীর্ঘজীবী হোন এই অনন্য শিল্পী।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...