"বাংলার মেলা-কথায়" মেলা নিয়ে মেলা কথা লেখা হয়েছে। এবারের পর্বে একটি বিশেষ উৎসব বা পার্বণ নিয়ে লিখব যে উৎসব একেবারে কৃষি প্রধান বাংলার কৃষি সমাজের নিজস্ব উৎসব। সেই উৎসব হলো নবান্ন উৎসব। নবান্ন উৎসব গ্ৰামীন বাংলার সহস্র বছরের প্রাচীন একটি ঐতিহ্যবাহী শস্য উৎসব । এই উৎসব পালিত হয় অগ্রহায়ন মাসেই। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, নতুন ধান উৎপাদনের সময় পিতৃ-পুরুষ অন্ন প্রার্থনা করে থাকেন। কৃষি প্রধান বাংলার গ্ৰামে গ্ৰামে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালন করা হয়, তার মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ হলো "নবান্ন"। নবান্ন" শব্দের অর্থ "নতুন অন্ন"।
নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চাল দিয়ে প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসবকেই আমরা নবান্ন উৎসব নামে জানি। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে পেকে ওঠা আমন ধান কাটার পর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি নবান্ন উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি জাতি-ধর্ম-বর্ণকে উপেক্ষা করে নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে আনন্দে মেতে ওঠে।
সাধারনত শীতের নতুন খেজুড়ের গুড় দিয়ে নতুন চালের তৈরি খাবার বানিয়ে মা লক্ষ্মীকে নিবেদন করে প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের খাওয়ানো, নিজের পরিবারের মানুষদের সঙ্গে আনন্দ করে সেই প্রসাদ গ্ৰহন করা, পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্য বিনিময় হলো নবান্ন উৎসবের মূল লক্ষ্য। এবং তার সঙ্গে সঙ্গে কাককে এই নতুন চালের অন্ন দেওয়াও নবান্নের একটি অঙ্গ। এটি একটি বিশেষ লৌকিক প্রথা। গ্ৰামবাংলার মানুষরা বিশ্বাস করেন যে কাকের মাধ্যমে ওই নৈবেদ্য পূর্ব-পুরুষদের কাছে পৌঁছে যায়। এই নৈবেদ্যকে বলা হয় "কাকবলী"।
আমাদের সোনার বাংলায় সোনালী আমন ধান পেকে ওঠে এবং কাটা হয় এই অঘ্রান মাসে। নবান্ন আসলে হেমন্তের প্রাণ। নতুন ধান ঘরে আসার পর শুরু হয় চালের তৈরি পিঠাপুলি খাওয়ার নবান্ন উৎসব। নতুন ধানের চাল দিয়ে পিঠা, পায়েস, ক্ষীরসহ নানা রকম খাবার তৈরি হয় গ্ৰাম বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে। নতুন ধানের পিঠা-পায়েসের ঘ্রাণে ভরে ওঠে চারপাশ। বাঙালির ঘরে ঘরে নবান্নের হইচই পড়ে যায়। ধানচাষের সঙ্গে যুক্ত কৃষক ও কৃষিকাজে যুক্ত মানুষগুলোর সারা বছরের উপার্জন আসে এই সময়েই। তাই মানুষের মন ও থাকে প্রফুল্ল। এই আনন্দ, খুশিরই প্রকাশ ঘটে নবান্ন অনুষ্ঠানে। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের অন্যতম এই উৎসব যেন সত্যি মানুষে মানুষে হৃদয়ের বন্ধনকে আরো গাঢ় করে তোলে। চিরাচরিত এই নবান্ন উৎসবে যেন লুকিয়ে আছে আমাদের সংস্কৃতির শেকড়।
গ্ৰাম বাংলায় যথেষ্ট উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে এই উৎসব পালিত হয়। কিন্তু কৃষিতে আমাদের রাজ্যে সবথেকে বেশি এগিয়ে আছে পূর্ব বর্ধমান জেলা। আজ এই পর্বে লেখা যাক পশ্চিমবঙ্গের শস্যভাণ্ডার যে জেলাকে বলা হয় সেই পূর্ব বর্ধমান জেলার নবান্ন উৎসব এবং মেলা নিয়ে। আমাদের রাজ্যের তো অবশ্যই, দেশের সবচেয়ে বেশি ধান উৎপাদক অঞ্চলগুলির অন্যতম হলো পূর্ব বর্ধমান। অগ্রহায়ন মাসে আমন ধান ঘরে তোলার সময় পালিত হয় নবান্ন। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসের প্রথমদিকে বা মাঝামাঝি উদযাপন করা হয় নবান্ন উৎসব। ধান ঢেঁকিতে ভেঙে তৈরি হয় চাল।
সেই নতুন চাল, আখ, খেঁজুর, কলা, কমলালেবু, নলেন গুড়ে মেখে সর্ব প্রথম মা লক্ষ্মীকে নিবেদন করা হয়। ধান কাটার আগে সুন্দর ভাবে উঠোন লেপে শুকিয়ে বাড়ির মহিলারা দেওয়ালে সুন্দর করে আলপনা আঁকেন। তবে বর্ধমানের মানুষের বিশ্বাস যে বর্ধমান জেলার অধিষ্ঠাত্রী হলেন দেবী সর্বমঙ্গলা। এ বিশ্বাস শুধু বর্ধমানবাসীর নয়, সমগ্র রাঢ় বাংলার মানুষ বিশ্বাস করেন যে পুরো রাঢ় বঙ্গের রক্ষাকর্ত্রী দেবী সর্বমঙ্গলা। তাঁকে লক্ষ্মীরূপে অর্চনা করে, দেবীর বিশেষ পুজোর মধ্য দিয়ে বর্ধমানের নবান্ন উৎসব শুরু হয়। নতুন চালের সঙ্গে ন রকমের উপাদান দিয়ে এদিন দেবীর ভোগ তৈরি হয়। বিশেষ পুজোপাঠের পর দেবীকে নতুন চালে তৈরি ভোগ নিবেদন করা হয়। ভোগের মধ্যে থাকে পোলাও, নানা রকমের ভাজা, মাছের টক ও সুগন্ধি চালের পায়েস।
নবান্ন উৎসব উপলক্ষে পূর্ব বর্ধমান জেলার বহু গ্রামগঞ্জে আয়োজন করা হয় নবান্নমেলার। এই মেলায় শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব শ্রেণী, বিভিন্ন পেশার মানুষের ভিড় হয়। ছোট-বড় সব বয়সের মানুষকে উৎফুল্ল মনে মেলায় বেড়াতে দেখা যায়। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ এ উৎসব ভিন্নভাবে পালন করে। যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হয় কোথাও আবার কোনো কোনো মেলায় রাতভর চলে গানের উৎসব। নবীন-প্রবীণ সব বয়সের মানুষ এই উৎসবে উপস্থিত থাকেন । বাহারি সব খাবারের দোকানের পসরা সাজিয়ে বসেন মেলার বিক্রেতা ভাইয়েরা। গ্ৰামের বৌ মেয়েরাও মনের আনন্দে কেনে গয়না, নানারকম সাজগোজ, ঘর সাজানোর জিনিস। বাড়ির সবাই মিলে সোয়েটার, শাল জড়িয়ে সারারাত ধরে বসে যাত্রা দেখেন। আর ছোটরা নাগরদোলায় চড়ে, নতুন খেলনা পেয়ে খুশিতে আত্মহারা।
আজ এই নবান্ন উৎসব ও মেলা পর্ব শেষ করব কবি জীবনানন্দ দাশের লেখা সেই অবিস্মরণীয় কবিতার পংক্তি দিয়ে যা বোধহয় সব বাঙালির হৃদয়ের কথা–
'আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়।'