"আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে"- না না, আর দ্বারে নেই। "বসন্ত এসে গেছে"। বসন্ত কাল ভারি সুন্দর ঋতু। হাড়কাঁপানো শীতের শেষে স্নিগ্ধতার স্পর্শ নিয়ে আসে বসন্ত। গাছে গাছে নতুন কচি সবুজ পাতা জন্মায়। এই বসন্তের জয়গাথা গেয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত কত গান কত কবিতা লিখেছেন।.....
"নব বসন্তের গানের ডালি এনেছি তোদের দ্বারে। আয় আয় আয়"....
কিন্তু বসন্তের মতো অপরূপ সুন্দর ঋতুর যে অন্য একটা খারাপ দিকও আছে। সেটা হলো বিচ্ছিরি ধরনের কয়েকটা অসুখ করতে চায় এই বসন্তকালেই। তার মধ্যে একটি হলো পক্স বা বসন্ত। আর এই রোগ এলেই গাঁ গঞ্জের মানুষদের মনে পড়ে যায় এক দেবীর কথা- তিনি মা শীতলা।
এই বিজ্ঞানের চূড়ান্ত উন্নতির যুগেও এখনও লোকদেবী শীতলার প্রবল প্রভাব লক্ষ্য করা যায় আমাদের রাজ্য বা দেশের বিভিন্ন স্থানে। মানুষ বিশ্বাস করেন যে দেবী শীতলাকে পুজো আরাধনার মাধ্যমে সন্তুষ্ট করলে তিনি বসন্ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেবেন। যদিও এখন পৃথিবী থেকে স্মল পক্স নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে তবুও চিকেন পক্স বা জলবসন্ত থেকে রক্ষা পেতে মানুষ দেবী শীতলার পুজো দেন।
প্রচলিত যে দেবীমূর্তি তাতে মা শীতলার এক হাতে থাকে আরোগ্যকারী অমৃত ভর্তি কলস, অন্য হাতে থাকে ঝাঁটা যা কিনা পরিচ্ছন্নতার প্রতীক। শীতলা দেবীর মন্ত্র হল,
ওঁং নমামি শীতলাং দেবীং রাসভস্থাং দিগম্বরীম্।
মার্জ্জনীকলসোপেতাং সূর্পালঙ্কৃতমস্তকাম্।।
দেবী শীতলা মার্জ্জনী অর্থাৎ ঝাঁটাধারিণী এবং রাসভ অর্থাৎ গাধা তাঁর বাহন। এখানেই শীতলা রহস্য নিহীত রয়েছে।
আয়ুর্বেদ গ্রন্থ "ভাবপ্রকাশ" থেকে জানা যাচ্ছে, "মসূর্যেব হি শীতলা", অর্থাৎ বসন্ত রোগের অপর নাম হল শীতলা। আসলে বসন্তরোগীকে শীতল অর্থাৎ ঠাণ্ডা জিনিস খাওয়াতে বলেন চিকিৎসকরা, সেজন্য এই নাম এবং সেই একই কারণে যে দেবীর আরাধনা করা হয় বসন্ত রোগের থেকে বাঁচার জন্য সেই দেবীর নামও শীতলা।
প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রজ্ঞ গয়দাস বলেন, "আদৌ যে পিবন্তি খরনাদ: পয়: তেষাং ন ভবন্তি কদাচিৎ অপি ইহ দেহে শীতলিকা বিকার:", অর্থাৎ শীতলা বা বসন্ত রোগের প্রথম অবস্থায় গাধার দুধ পান করলে কোনো গুটি বের হয় না।
গয়দাস আরও বলেছেন, "রাসভস্য পয়: পীতং শীতলাজ্বর নাশনং", অর্থাৎ গাধার দুধ পান করলে তা বসন্ত রোগীর জ্বর নাশ করে অর্থাৎ উপশম হয়।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, গাধার দুধ হল বসন্ত রোগের এক প্রতিষেধক। আর এই কারণেই প্রাচীন কাল থেকেই মা শীতলার সঙ্গে জুড়ে গেছে গাধার নাম এবং ‘শীতলা মঙ্গল’ কাব্যের কবির কল্পনায় দেবীর বাহন রূপে গাধাকে দেখানো হয়েছে।
ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যে তো বটেই, তা ছাড়াও নেপাল, আসাম, বাংলাদেশ, এমনকি, পাকিস্তানেও দেবী শীতলা পূজিতা হন। বসন্ত কালেই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ধুমধাম করে শীতলা পুজো হয় এবং এই পুজো উপলক্ষে বসে মেলা।
আজ পাঠকবন্ধুদের নিয়ে যাওয়া যাক দক্ষিণ কলকাতা শহরতলির বাঁশদ্রোনী রানিয়া উদ্যানপল্লী শীতলা পুজোর মেলায়। স্থানীয় ক্লাবের পরিচালনায় খুব ধুমধাম করে পুজো এবং পনেরো দিনের মেলা হয় এখানে। এই পুজোর বয়স অন্ততঃ পঁচাত্তর বছর। এখানে মা শীতলার স্থায়ী মন্দির আছে। মন্দিরে বিশাল দেবী মূর্তি। প্রত্যেক বছর পুজোর আগের দিন পুরনো মূর্তি বিসর্জন দিয়ে নতুন মূর্তি স্থাপন করা হয়। মা শীতলার পুজোর দিন অঞ্চলের সব মহিলারা উপবাস করেন। যতক্ষণ পুজো শেষ না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত কারুর ঘরে আগুন জ্বলে না।
সেদিন সকলের বাড়িতে পুজোর পর পান্তা ভাত খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। দেবীকে ফল, বাতাসা, মিষ্টি দিয়ে পুজো দেওয়া হয়। ডাব বা ডাবের জল পুজোর একটি অত্যাবশ্যক উপকরণ। মন্দিরের কাছেই পুকুর রয়েছে। বহু মহিলা দণ্ডি কেটে মন্দির পর্যন্ত এসে পুকুরে ডুবে দিয়ে শুদ্ধ হয়ে তারপর পুজো দেন। বিজ্ঞান আর দৈব বিশ্বাস এখানে হাত ধরাধরি করে চলে। এই দেবীর কাছে অনেকে নানান মনোস্কামনা জানান এবং সেই বাসনা পূর্ণ হলে ছোট দেবীমূর্তি প্রদান করেন। মন্দিরের ভিতরে দেবীর বড়ো মূর্তি থাকলেও মন্দির প্রাঙ্গণও ভরে ওঠে ছোট ছোট দেবী শীতলার মূর্তিতে।
পাশেই বড়ো মাঠে বসে মেলা। পুজোর আগের দিনই দোকানদাররা তাদের দোকানপাট সাজিয়ে ফেলেন। দুপুর থেকেই গিজগিজ করে মানুষ। বেশিরভাগই মহিলা এবং শিশু। মেলাটিও বেশ বড়সড়। বাচ্চাদের জন্য নানান রকম জয়রাইডস বসে। একটু বড়োদের জন্য নাগরদোলা। আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে মেলার মাঠ।
আর এই মেলাতে পাওয়া যায় না এমন গৃহস্থালির জিনিস খুব কম আছে। কাঠের বাসন, কাঠের তৈরি ছোটখাটো আসবাবপত্র, স্টিলের, কাঁচের, চিনামাটির তৈজসপত্র, খেলনা, পুতুল, বই, খাবার, ঘর সাজানোর জিনিস, মেয়েদের সাজগোজের জিনিসপত্র, গয়না কী না পাওয়া যায় এই মেলাতে! আর রকমারি খাবারের স্টলগুলিতে ভিড় সামলাতে সামলাতে স্বেচ্ছাসেবকদের হিমশিম খাওয়ার উপক্রম হয়। পনেরো দিনের এই মেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হয়। মানুষজন বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন নিয়ে আসেন সেইসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার জন্য। ক্রেতা বিক্রেতা সকলের মুখেই ফুটে ওঠে হাসি। পনেরো দিন পর শেষ হয় এই শীতলা পুজোর মেলা।
আজকের মেলা কথা এখানে শেষ করা যাক। আমার জিয়ো বাংলার পাঠকবন্ধুদের জানাই বাসন্তী শুভেচ্ছা। সবাই ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন।