বাংলার মেলা-কথা: বোল্লাকালীর মেলা

মেলা কথায় এবার একটু উত্তরবঙ্গের দিকে যাওয়া যাক। এই মেলাটি হয় দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায়। ঐ জেলার গাজল-হিলি ৫১২নং জাতীয় সড়ক থেকে দুই কিলোমিটার দূরে বোল্লা গ্ৰামে বসে উত্তরপূর্ব ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম মেলা ‘বোল্লা কালীর মেলা’। প্রতি বছর রাস পূর্ণিমার পরের শুক্রবার রাতে হওয়া কালীপূজাকে কেন্দ্র করে এই মেলার আয়োজন হয়। চারদিনের এই মেলা শুক্রবার থেকে শুরু হয়ে শেষ হয় পরের সোমবার রাতে। এবার জেনে নেওয়া যাক মা কালীর এরকম নামকরণ কীভাবে হলো এবং এই মেলার ইতিহাস।

৪০০ বছর আগে এই এলাকায় বল্লভ চৌধুরি নামে এক জমিদার ছিলেন। তার নাম অনুসারেই এলাকার নাম হয়েছে বোল্লা। কথিত আছে, প্রায় ৪০০ বছর আগে এলাকার এক মহিলা স্বপ্নাদেশে কালো একটি প্রস্তরখণ্ড কুড়িয়ে পেয়ে সেটিকে প্রথম মাকালী রূপে পুজো শুরু করেছিলেন।

 

bollakali1

 

এখানে সেইসময় দেবী কালীর কোনো বড়ো মন্দির ছিল না। পরবর্তী সময়ে ইংরেজদের রাজত্বকালে স্থানীয় এক জমিদার মুরারীমোহন চৌধুরি ইংরেজদের ধার্য করা কর দিতে না পারায় ইংরেজদের সঙ্গে মামলায় জড়িয়ে যান। কর না দিতে পারার অপরাধে ইংরেজ শাসককূল সেই জমিদারকে গ্রেফতার করে। ওই জমিদার নিজের মুক্তির জন্য মা কালীর কাছে প্রার্থনা করেন। মা কালী তাঁর ডাকে সাড়া দেন এবং জমিদার পরের দিনই ছাড়া পেয়ে যান।

এর পরই মা কালীর প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রতীক হিসাবে তিনি মায়ের মন্দির তৈরি করিয়ে দেন এবং ধূমধাম করে মা কালীর পুজো করেন। জমিদারের ছাড়া পাওয়ার দিনটি ছিল রাস পূর্ণিমার পরের শুক্রবার। তখন থেকেই ঐ দিন জাঁকজমক সহকারে মায়ের পুজো হয় এবং মেলা বসে।

স্থানীয় মানুষদের কাছে শোনা যায় মা অত্যন্ত জাগ্ৰত। এই অঞ্চলের মানুষদের বিপদ আপদ থেকে সবসময় রক্ষা করে এসেছেন। তাই এই দেবীকে রক্ষাকালী নামেই ডেকে এসেছেন দক্ষিণ দিনাজপুরের মানুষ। পরবর্তী সময়ে ‘বোল্লার রক্ষাকালী’ মানুষের মুখে  মুখে দাঁড়ায় ‘বোল্লা কালী’তে। এই ‘বোল্লা কালীর’ পুজোকে কেন্দ্র করেই চারদিন  ব্যাপী চলে বিরাট মেলা। এই মেলায় শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের নয়, সকল ধর্মের মানুষরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেন। মায়ের পূজায় সারা বছর শুক্রবার অন্ন ভোগ হলেও মূল উৎসবের দিন অর্থাৎ রাস পূর্ণিমার পরের শুক্রবার মিষ্টি ও ফল ভোগে মায়ের পূজা হয়। মন্দিরকে সুন্দর করে সাজানো হয়। তিন দিন ধরে উৎসবও চলে।

 

bollakali3

 

জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজার হাজার ভক্ত আসেন। পাশাপাশি জেলা যেমন মালদা, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, রাজ্য যেমন বিহার, আসাম এমনকি প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ, নেপাল থেকে পর্যন্ত মানুষ আসেন এই মেলায়। লক্ষাধিক ভক্ত দর্শনার্থীর ভিড়ে জমে ওঠে উৎসব ও পুজো। জল্পেশের মেলার পর উত্তরবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম মেলা হল এই বোল্লাকালীর মেলা। দিল্লি, মুম্বই এমনকী বিদেশ থেকেও পুণ্যার্থীরা পুজো দিতে মন্দিরে ভিড় জমান। এই মন্দিরে বলি প্রথা চালু রয়েছে। প্রতিবছর পুজোর রাতে ৬ হাজারের বেশি পাঁঠা বলি হয়। একই সঙ্গে মণ্ডপ চত্বরেই ছোট-বড় মানতের কালীর পুজো হয়। ভক্তরা ২ হাজারের বেশি ছোট কালী মূর্তি বোল্লা কালীর কাছে নিবেদন করেন।

মা বোল্লাকালীর সাড়ে সাত হাত মূর্তি তৈরি করা হয়। প্রায় তিরিশ কেজি স্বর্ণালঙ্কারে মা'কে সজ্জিত করা হয়। দেবীর হাতে সোনার খড়্গ তুলে দেওয়া হয়। এবং দেবীর তৃতীয় নয়নে থাকে একটি হীরে। প্রতি বছরই ভক্তরা মা'কে সোনার এবং রূপার গহনা দিয়ে থাকেন।

 

bollakali2

 

মেলায় পুতুল নাচ, নাগরদোলা, সার্কাস, ম্যাজিক, নাচ গান ইত্যাদি সবরকমের বিনোদনের ব্যবস্থাই থাকে। খাবার, খেলনা, গহনা ও গৃহস্থালির নানান পসরা নিয়ে দূরদূরান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা হাজির হন। বসে নানা ধরনের খাবারের স্টল। মেলার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো মিষ্টির দোকানগুলিতে তৈরি ১২ ইঞ্চি লম্বা ও ৬ ইঞ্চি লম্বা ল্যাংচা ও চমচম। বিরাট বড় বড় কদমা ও খাজা অন্যতম আকর্ষণ। মন্দির প্রাঙ্গণ সাধারণ মানুষের ভিড়ে গম গম করে। কদমা ও খাজা-বাতাসার মানতের ঢল নামে মন্দিরে।

সাধারণত দর্শনার্থীরা মায়ের কাছে পুজো নিবেদন করতে হাঁড়িতে বাতাসা, সন্দেশ, ছোট কদমা দিয়ে থাকেন। ভক্তরা দীর্ঘ সময় ধরে লাইন দিয়ে অপেক্ষা করেন মা কালীকে দর্শন ও পুজো করার জন্য। প্রথা মেনে নিষ্ঠা সহকারে শুক্রবার ঐতিহ্যবাহী এই দেবী বোল্লা কালীর পুজো শুরু হয়। নির্বিঘ্নে যাতে সুষ্ঠুভাবে পুজো সম্পূর্ণ হয় তার জন্য পুলিসের তৎপরতা থাকে চোখে পরার মতো। সিসিটিভির মধ্য দিয়ে পুলিস পুরো মেলার উপর নজরদারি চালায়। মেলা ও মা'র পুজোর সময় বালুরঘাট ও গঙ্গারামপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে দর্শনার্থীদের বোল্লা গ্রামে পৌঁছতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সারা রাত সরকারি ও বেসরকারি বাস, মিনিবাস ট্রেকার, অটোর ব্যবস্থাও করা হয়। বালুরঘাট, গঙ্গারামপুর শহরের প্রায় সব হোটেল ভর্তি হয়ে যায়। এমন কি দর্শনার্থীদের চাহিদা মেনে রেল কর্তৃপক্ষও বোল্লা গ্রামের কাছে বিকোচ এলাকায় ট্রেনের স্টপেজ চালু করে। পরের সোমবার মায়ের বিসর্জন হয় পাশের পুকুরে। সেইসঙ্গে মেলাও শেষ হয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...