বাংলার মেলা কথা: উত্তর চব্বিশ পরগনা ঠাকুরনগর মতুয়া মহামেলা

ভারতবর্ষ তথা বাংলায় মেলা হলো মহোৎসব, মানুষের প্রাণের উৎসব। এ যেন বেঁচে থাকার আনন্দ। ধর্মীয় উৎসব বা দেবদেবী উপলক্ষ্য মাত্র। কিন্তু সেই উপলক্ষ্যেই বাড়িতে কতো মানুষ কতো আত্মীয়স্বজনের পায়ের ছোঁয়া লাগবে! গৃহকর্তা/কর্ত্রী কতো না "আসো জন- বসো জন" বলে আপ্যায়ন করবেন! সাজগোজ, আমোদ আহ্লাদ, খাওয়া দাওয়া, হাসি মজা হৈ হুল্লোড়, জাঁকজমক, আলোর রোশনাই, কেনা কাটা– এই সবই মেলার এক একটি অংশ। এই যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণের আবেগ, আনন্দের ঝর্ণাধারায় অবগাহন করা এগুলোই তো সাধারণ বাজারের সঙ্গে মেলার পার্থক্য তৈরি করে দেয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় – ‘ছোট আমি নয়, বড় আমি’র মধ্যে নিজেকে অনুভব করা, নিজের প্রাণের মধ্যে সমস্ত মানুষকে পাওয়া। নিজেকে সমস্ত মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া "— তেমন উৎসবই হলো মেলা।

আমাদের বাংলায় অসংখ্য মেলা বসে। কোনওটা শহরের, কোনওটা গ্ৰামীন আবার কোনওটা আবার আন্তর্জাতিকও। এর মধ্যে তিনটি মেলাকে ‘আন্তর্জাতিক মেলা’ বলা যেতে পারে। সেই তিনটি মেলা হল— গঙ্গাসাগর মেলা, কলকাতা বইমেলা এবং উত্তর চব্বিশ পরগনার ঠাকুরনগরের মতুয়া মহামেলা।

১৮১২ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুর জেলা(বর্তমান বাংলাদেশের)ওড়াকান্দি গ্ৰামে মতুয়া ধর্ম আন্দোলনের প্রবর্তক হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্ম হয়। প্রচলিত বিভিন্ন ধর্ম ভাবনা থেকে এই মতুয়া ধর্ম ভাবনা নানা কারণে একটু আলাদা। এই ধর্ম কোনও শাস্ত্রীয় আচারের কথা বলে না। বরং এই ধর্ম আন্দোলন এসব থেকে মুক্তির পথ দেখায়। এই ধর্ম বলে নিরলস কর্মের কথা, কামনাহীন প্রেমভক্তির মধ্য দিয়ে চিত্তশুদ্ধির কথা, শিক্ষা প্রসারের কথা, মানুষের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসার কথা। হরিচাঁদ ঠাকুর এবং তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর জাত, বর্ণ, ধর্ম সব কিছুর উর্ধ্বে উঠে মানবিকতার এক মহান আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। স্থাপিত হয়েছিল মতুয়া মহা সংঘ। এই মতুয়া মহা সংঘ প্রথমে ফরিদপুরে ওড়াকান্দিতে প্রতিবছর চৈত্রমাসের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথি উপলক্ষে মহাবারুণী মেলার সূচনা করেছিল। দেশ ভাগের পর পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনার বনগাঁ মহকুমায় প্রতিষ্ঠিত হয় হরিচাঁদ ঠাকুরের স্মৃতিতে ‘ঠাকুরনগর’ এবং শুরু হয় বাৎসরিক মহাবারুণী উৎসব যার বর্তমান নাম ‘মতুয়া মহামেলা’।

Matua-Gurudeb

ঠাকুরনগর প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে এবং ১৯৪৯ থেকে শুরু হয়ে মতুয়া মহামেলা। হরিচাঁদ ঠাকুরের পৌত্র প্রমথরঞ্জন ঠাকুর ঠাকুরনগরে এই মেলার সূচনা করেছিলেন। এরপর থেকে প্রতি বছরই চৈত্র মাসে মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়ে চলছে। তবে করোনা মহামারীর কারণে ২০২০ সালে মেলাটি স্থগিত রাখা হয়েছিল। এই মেলা বর্তমান সময়ে শহর, রাজ্য, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মেলায় পরিণত হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে এমনকি সুদূর আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ থেকে পর্যন্ত মতুয়া ভক্তরা এই মেলায় আসেন। এই মহামিলনমেলাকে কেন্দ্র করে মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, ছত্তিশগড়, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা-সহ দেশের প্রায় প্রতিটি রাজ্য থেকেই মতুয়া ভক্তেরা ঠাকুরবাড়ি আসেন। বাংলাদেশ, মায়ানমার থেকেও আসেন অনেক ভক্ত। প্রতি বছর হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথি মধু কৃষ্ণত্রয়োদশীতে কামনা সাগর'-এ পুণ্যস্নানের মধ্য দিয়ে ওই মেলা শুরু হয়। অন্যান্য ধর্ম স্থানে বা ধর্মীয় মেলায় ভক্তবৃন্দ যেভাবে আসেন, ঠাকুরনগর মতুয়া মহামেলায় মতুয়া ভক্তরা সেভাবে আসেন না। মেলায় ভক্তবৃন্দের আসা এবং যাওয়ার বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। ঠাকুরনগরের এই মেলাকে সমুদ্রের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে কারণ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত ছোট ছোট মতুয়া দলগুলোকে নদী বলা যায়। মহাসমুদ্রের টানে যেমন নদী ছন্দময় বেগে ছুটে চলে তেমনি ছোট ছোট মতুয়া দলগুলি ছন্দময় তালে তালে মতুয়া মহা মিলনায়তনে যোগদান করে। ঢেউয়ের মত নাচে গানে মুখর মতুয়া দলগুলি এসে মিশে যায় মহামেলার জনসমুদ্রে। গীতে বাদ্যে সেই জনসাগর তখন আরও ধ্বনিময়। আনন্দ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে মতুয়া মহামেলার মহামিলন ভূমি যার কোন তুলনা নেই। হাজার হাজার মতুয়া দল সুশৃংখলভাবে জয়ডঙ্কা ও শিঙা বাজিয়ে, নিশান উড়িয়ে, নৃত্যের তালে তালে, নামে গানে মাতোয়ারা হয়ে মহামেলায় যোগদান করে আবার একইভাবে সুশৃংখল রীতিতে বেরিয়ে যায়। ভক্তদের মধ্যে তখন ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু কোন শ্রেণীবিভাগ থাকে না। উৎসবের সময় মেলা সংলগ্ন এলাকায় প্রতিটি বাড়ির দরজা এ সময় ভক্তদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। বাড়ির মালিক পুণ্যার্থীদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেন। বিভিন্ন ক্লাব ও স্বেচ্ছাসেবী সংঠনের পক্ষ থেকে ঠাকুরনগর খেলার মাঠ-সহ নানা এলাকায় বিশাল প্যান্ডেল করা হয়। দর্শনার্থীরা এবং মতুয়া ভক্তরা যাতে গরমে পিপাসায় কষ্ট না পান তার জন্য খোলা হয় প্রচুর জলসত্র।

matuamela-02

এই মেলায় মৃৎশিল্পী, কাঠ শিল্পী, ময়রা, মুদি, কামার, মালাকার, সাজ শিল্পী, ছোট ছোট কুটির শিল্প সামগ্রী যারা বিক্রি করেন তারা সবাই অপেক্ষা করে থাকেন এই ক’দিনের মতুয়া মেলার রোজগারের জন্য। কেবল অপেক্ষা করেন না, আর্থিকভাবে সুসমৃদ্ধও হন মতুয়া মেলা থেকে। ঠাকুরনগরের মেলায় হাতা, খুন্তি, কড়াই, হাঁড়ি থেকে শিলনোড়া, বেতের আসবাবপত্র, বাঁশের বোনা নানা সামগ্রী থরে থরে সাজানো থাকে মেলার অস্থায়ী দোকানে। নাম-গানে মাতোয়ারা মতুয়া দল গুলি যখন হরি মন্দিরের সামনে নাচ গান করেন ভক্ত গৃহী নারী-পুরুষরা তাদের উদ্দেশ্যে মুঠো মুঠো বাতাসা ছিটিয়ে দেন; এই কারণে মতুয়া মহা মেলায় প্রচুর বাতাসার দোকানও বসে এই মেলায় বিক্রি হয় কিছু বিরল সামগ্রী যেমন হুঁকো, কল্কে, কাঠের খড়ম প্রভৃতি। খাবারের স্টলগুলি ভিড়ে ভিড়ে জমজমাট।

matua-mela-01

পৃথিবীতে আর কোথাও এমন মেলা বসে না যেখানে হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান একই সঙ্গে একই ধর্মমতে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। এমন কোন ধর্মীয় ব্যক্তি নেই যাকে শ্রদ্ধা জানাতে সমস্ত বিভেদ ভুলে সমাজের সকল শ্রেণীর সকল ধর্মের লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ একই উৎসবে উপস্থিত হন। এমনই এক জন-উৎসব হল ঠাকুরনগরের মতুয়া মহামেলা যা সত্যিকারের জীবনের উৎসব।

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...