বাংলার মেলা: মহারাজের মেলা

মেলা পর্বে এবার যাওয়া যাক উত্তরবঙ্গের এক গ্ৰামে। গ্ৰামের নাম "রংধামালি"। কেমন সুন্দর নাম তাই না? শুধু যে গ্ৰামটির নামই সুন্দর তাই নয়, এই জায়গার একটি বিশেষত্বও আছে। স্বয়ং মা দুর্গা নাকি সেখানে তাঁর ছেলেপুলে নিয়ে একদিন বিশ্রাম করেছিলেন। আশ্চর্য হয়ে যাওয়ার মতো তথ্য তাই না? চলুন, জেনে নেওয়া যাক জলপাইগুড়ি জেলার ছোট্ট গ্ৰাম রংধামালির পুজো এবং মেলা সম্পর্কিত কিছু তথ্য। চলুন, রওনা দেওয়া যাক সেই মেলার পথে।

 

বাঙালিদের বিশ্বাস অনুযায়ী প্রত্যেক বছর মাত্র চারদিনের জন্য মা দুর্গা কৈলাস থেকে তাঁর চার সন্তান নিয়ে এই মর্ত্যধামে আসেন। সেই উপলক্ষে কত আড়ম্বর, কত আয়োজন। কিন্তু মোটে চারদিনের জন্য থাকেন তিনি। তারপরই রওনা দেন কৈলাসের পথে। পড়ে থাকে শুকনো ফুলের মালা, ফাঁকা প্যান্ডেল, ডেকরেটর্সের রঙিন কাপড়ের স্তূপ। রাস্তার একপাশে জড়ো করা প্যান্ডেল বানানোর বাঁশ। আমাদের সকলেরই মন বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। কেটে যায় লক্ষ্মীপুজোও‌। কেমন ঝুপ করে নামে হেমন্তের মনখারাপ করা সন্ধ্যা। বাতাসে লাগে হিমের ছোঁয়া।

 

RangdhamaliFair1

 

কিন্তু, উৎসব শেষের এই বিষাদবেলাতেই খুশিতে, আনন্দে মেতে ওঠে উত্তর বাংলার জলপাইগুড়ি জেলার ছোট গ্ৰাম "রংধামালি"। সেখানে যে এবার মা আসছেন! লোককথা অনুযায়ী মা দুর্গা যখন তাঁর "বাপের বাড়ি"তে চারদিন কাটিয়ে নিজের বাড়ির দিকে রওনা দেন তখন অতটা পথ টানা যেতে যেতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন। মা জননী তিনি, দুর্গতিনাশিনী মহিষাসুরমর্দিনী। চারদিনের অত খাটাখাটনির পর অতটা পথ যেতে ক্লান্তি বোধ করতেই পারেন তিনি। তখন এই তিস্তা নদীর পারে রংধামালির এক বাগানে তিনি নাকি তাঁর সন্তান সন্ততিদের নিয়ে একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বসে পড়েছিলেন। খবর পেয়ে গেল গ্ৰামবাসীরা। সবাই ছুটে এল। স্বয়ং জগজ্জননী এসেছেন তাদের গ্ৰামে! কত সৌভাগ্য তাদের!

 

কেউ বাতাস করে, কেউ জল বাতাসা দেয়, কেউ আসন এগিয়ে দেয়। তারপর সবাই মিলে প্রণাম করে হাতজোড় করে প্রার্থনা করে "মা, তুমি আমাদের কাছে অন্ততঃ একটা দিন থেকে যাও। আমরা তোমার সেবা করে ধন্য হই"। জগদীশ্বরী কি তাঁর ভক্তদের অনুরোধ ফেলতে পারেন! তিনি রাজি হয়ে গেলেন। ব্যস্, মহা ধুমধাম করে মায়ের পুজো হল আবার। তবে তিনদিন নয়, একদিনেই এই পুজো শেষ হলো। মা সন্তুষ্ট হয়ে গ্ৰামবাসীদের আশীর্বাদ করে বিদায় নিলেন। এবার না গেলে যে তাঁর কর্তাটি, মানে মহেশ্বর রাগ করবেন, দুঃখ পাবেন। তাই তিনি তাঁর ছেলেপুলে নিয়ে এবার ফিরে চলেন তাঁর বাড়ির পথে।

 

Maharajer Mela - 1 (1)

 

রংধামালির এই দুর্গাপূজা হয় কোজাগরী পূর্ণিমার পরের বৃহস্পতিবার। একই দিনে বোধন, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী সব তিথির পুজো হয়। সারা গ্ৰাম মেতে ওঠে আনন্দে। আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে রংধামালি। নতুন জামা-কাপড় পরে হৈচৈ শুরু করে শিশুর দল। নতুন শাড়িতে সেজে মা দুর্গাকে বরণ করে মা বৌয়েরা। মা দুর্গা, মহাদেব, তাঁদের সন্ততিদের পাশাপাশি মায়ের দুই সখী জয়া এবং বিজয়াকেও পুজো করা হয় এখানে। পুজোয় বলিরও নিয়ম রয়েছে।

 

আর এই পুজো উপলক্ষে বসে তিনদিনের মেলা। যে বাগানে মা দুর্গা বসেছিলেন বিশ্রাম নিতে সেই বাগানের মালিক 'মহারাজের নামেই এই পুজোকে "মহারাজের পুজো" এবং মেলাকে "মহারাজের মেলা"ও বলা হয়। তিনদিন ধরে মহা আড়ম্বরে চলে এই মেলা। নাগরদোলা, আতসবাজি, বাঁশির পিঁ পিঁ আওয়াজ, আলোর রোশনাই, নানারকম খেলনা, ঘরকন্নার জিনিসপত্র, রকমারি খাবার, ইমিটেশন গহনা – কী না পাওয়া যায় এই মেলায়। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের বেশ কিছুদিনের সংস্থানের ব্যবস্থা হয়ে যায় এই মেলায় বিক্রিবাটা কেনাকাটা থেকে। এই পুজোতে রংধামালির ছেলেপুলেদের নতুন জামা জুতো চাইই চাই। তিনদিনের পর ভাঙে এই মেলা। অপেক্ষা শুরু হয় পরের বছরের জন্য।

এই সপ্তাহের মেলায় বেড়ানো এই পর্যন্তই। পরের সপ্তাহে আবার নতুন একটা মেলায় বেড়াতে যাওয়া যাবে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...