আমাদের এই বাংলায় কতই না বৈচিত্র্য, কত উৎসব। প্রতি ঋতুতে নতুন নতুন উৎসব। উৎসব মানেই আনন্দ, হই চই, নতুন নতুন জিনিস কেনাকাটা আর নতুন নতুন মেলা। বঙ্গ দেশে উৎসবের অভাব নেই তাই মেলাও অগুন্তি। দুর্গাপূজা তো শেষ। তাতে কি, এবার আসছে আলোর উৎসব দীপাবলি। আর সেই আলোর উৎসব যে দেবীর আরাধনা উপলক্ষে সেই দেবী দীপান্বিতা মা কালিকার পুজো। এবারের মেলা পর্ব সেই কালি পুজো উপলক্ষেই।
আমাদের এবারের গন্তব্য মালদা জেলা। মালদহ শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে একটা ছোট্ট গ্রাম গোবরজনা। নামটা একটু কেমন কেমন হলেও গ্রামটি কিন্তু ভারি মিষ্টি। আর এই গোবরজনা গ্রামেই হয় একটি সাড়ে তিনশো বছরের ঐতিহ্যবাহী কালী পূজা এবং সেই উপলক্ষে বেশ বড় একটা মেলা। সে আবার যে সে কালী মাতা নন, ইনি হলেন একজন ডাকাতিয়া কালী। মানে আগেকার দিনে ডাকাতদল ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে এই দেবী মায়ের পুজো করে তারপর হা রে রে রে রে রে বলে ডাক ছেড়ে ডাকাতি করতে বেরোত। চলুন তাহলে, গোবরজনার এই ডাকাতে কালীর পুজোর খোঁজ খবর নিয়ে আসা যাক এবং তার সঙ্গে মেলাতেও বেড়ানো হোক।
এই গ্ৰামের প্রবীণ ও প্রাচীন মানুষদের কথায় কান পাতলে এরকম কথাই শোনা যায় যে সাড়ে তিনশো বছর আগে এই গোবরজনা গ্ৰামে ছিল না কোনো জনবসতি। ছিল শুধু গভীর জঙ্গল আর হিংস্র জানোয়ারের দল। মানুষের আনাগোনা এই এলাকায় ছিল না বললেই চলে। আর এই গ্ৰামটা থেকে বিহারে যাওয়া আসা করা ছিল বেশ সহজ। জনবসতি না থাকার সুযোগে বিহার থেকে একদল রাজপুত ডাকাত এই জঙ্গলে লুকিয়ে আশ্রয় নিল। এরা জঙ্গল পরিষ্কার করে দিনে চাষবাস করতো আর প্রায়ই রাতের বেলায় বিহারে বা মালদার বিভিন্ন প্রান্তে ডাকাতি করতে যেত।
ডাকাতি করতে যাওয়ার আগেও ডাকাতি করে ফিরে এসে এই ডাকাত দল মাকালীর পুজো করতো শক্তির দেবী হিসেবে। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে এই ডাকাতরা নিজেরাই প্রত্যেক বছর দেবী কালীর মূর্তি গড়ে মা কালীর আরাধনা করত। এরপর দিন কেটেছে, বছর কেটেছে, জঙ্গল পরিষ্কার হয়ে গিয়ে লোকবসতি তৈরি হয়েছে, নতুন গ্ৰাম তৈরি হয়েছে। কেটে গেছে সাড়ে তিনশো বছর। সেই ডাকাত দলও নেই। কিন্তু সেই কালীপূজা থেকে গেছে। বর্তমানে মালদহে জেলার প্রাচীন এবং বিখ্যাত কালী পূজাগুলির মধ্যে অন্যতম হলো গোবরজনার এই ডাকাতে কালীর পুজো। গ্রামের মানুষ অতি আগ্রহ নিয়ে এই পুজোয় অংশ নেন।
প্রতিষ্ঠিত মন্দির রয়েছে এই গ্ৰামে কালিন্দী নদীর তীরে। আর মন্দির সংলগ্ন তীরবর্তী এলাকাতেই বসে বিশাল মেলা। প্রতি বছর দীপান্বিতা কালীপুজোয় প্রচুর ভক্ত সমাগম ঘটে এখানে। মেলাতেও তাই প্রচুর ভিড় হয়। পুজোয় স্থানীয় মানুষজন প্রচুর দান করেন। মায়ের অনেক গহনাও রয়েছে। এই সময় সেই গহনাগুলি দিয়ে দেবীকে সাজানো হয়। অত্যন্ত ধুমধাম সহকারে পুজো হয়। কার্তিক মাসের অমাবস্যায় প্রাচীন রীতিনীতি মেনেই দেবীর আরাধনা করা হয়।
সারারাত ধরে বলিও দেওয়া হয়। গোবরজনার এই ডাকাতে কালী পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, এই উৎসবে হিন্দুধর্মের মানুষ ছাড়াও ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষরাও সানন্দে যোগদান করেন। ভিন্নধর্মী বহু স্বেচ্ছাসেবক ভক্ত রয়েছে মায়ের যারা এই মেলার ভীড় সামলান, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সহযোগিতা করেন যাতে সুষ্ঠুভাবে এই পুজো এবং মেলা ঠিকঠাক ভাবে সম্পন্ন হতে পারে।
কথিত আছে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সৃষ্ট 'দেবী চৌধুরাণী' উপন্যাসের নায়িকা প্রফুল্ল এবং তার গুরু ভবানী পাঠকের নামও নাকি জড়িয়ে আছে এই কালীমাতার সঙ্গে। একবার নাকি উত্তরবঙ্গ যাওয়ার পথে তাদের নৌকা এখানে চড়ায় আটকে গিয়েছিল। কিছুতেই ছাড়ছিল না। তখন দেবী চৌধুরানী বা প্রফুল্ল এই দেবীর কাছে এসে পুজো দিয়ে প্রার্থনা জানান। তারপর তার বজরা ছাড়ে। এই কারণে অনেকে এই পুজোকে ভবানী পাঠকের পুজোও বলে থাকেন। তবে এই কাহিনীর কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।
পুজো উপলক্ষে বসে দু-তিনদিনের মেলা। এই গোবরজনা ডাকাতে কালীমা এতটাই জাগ্ৰত যে পুজো দিতে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা তো বটেই, বিহার, এমনকি বাংলাদেশ থেকেও ভক্তরা আসেন। অন্যান্য মেলার মতোই এই মেলাতেও মেলে রকমারি খাবার, খেলনা, গেরস্থালির নানান পশরা সাজিয়ে নিয়ে বসেন দোকানদারেরা। আলোয় আলোয় সেজে ওঠে মন্দির ও চারপাশের এলাকা। মানুষজন ঠাকুর দেখতে এসে পুজো দিয়ে, মেলাতে বেড়িয়ে, মনের সুখে কেনাকাটা করে, ফুচকা ঘুঘনি এগরোল খেয়ে খুশি হয়ে ফেরেন। ছোটরাও এত আলো, ঠাকুর, মেলা এত কিছু দেখে, নিজেদের পছন্দের খেলনা পেয়ে আহ্লাদে আটখানা। সার্থক উৎসব, সার্থক মেলা।
এবারের মেলা-কথায় মেলা কথা বলা হয়ে গেল। দেখা হবে আরেক মেলায়।