এইবারের মেলা পর্বে আমরা রওনা দেব মালদা জেলার পথে। মালদা জেলার উত্তর দিকের সীমান্তের কিছুটা অংশ দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। এই অংশটা অনেকটা উটের কুঁজের মতো দেখতে। হয়ে এই অংশের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে মালদা-বালুরঘাট সংযোগকারী উত্তরমুখী রাস্তায় দত্ততলা নামের একটি জায়গা থেকে পশ্চিমে প্রায় ৫ কিলোমিটার গেলে আমরা পৌঁছে যাব ধাওয়াইল গ্রাম। আমরা মেলা দেখতে যাব এই গ্ৰামেই। মেলার নাম কংসব্রতর মেলা।
স্থানীয় বয়স্ক মানুষরা বলে থাকেন ধাওয়াইল গ্রামের কংসব্রতর মেলা প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো। এই গ্রামের মধ্যে এক পুকুরের পাড়ে রয়েছে বহু প্রাচীন এক বটগাছ। জীর্ণ এই বটের নীচে ‘কংসের বেদী’ নামে একটি বেদী আছে যার উপর আছে কষ্টিপাথরের এক মূর্তি। মূর্তিটির বক্ষদেশ থেকে উপরিভাগ নেই এবং পদদ্বয় হাঁটু থেকে ভাঙা।গ্রামের সবাই এই মূর্তিকে কংসের মূর্তি বলে দাবি করেন। মূর্তির চারিদিকে আরো কয়েকটি ছোট পাথরের মূর্তি আছে। পাথরের এই মূর্তি এবং এই উৎসব সম্পর্কে কিংবদন্তী এই যে অতীতে এই গ্রামেই শ্রীকৃষ্ণ কংসকে বধ করেছিলেন। সেই বিশেষ ঘটনাকে স্মরণ করেই প্রতিবছর এই কংসব্রত উৎসব ও মেলার শুরু হয়েছিল।
গবেষকদের অনুমান বহু পূর্বে এই অঞ্চলে কংস নামে শক্তির উপাসক কোনও রাজা ছিলেন। পরবর্তী সময়ে শ্রীচৈতন্য মালদহ জেলার রামকেলিতে এসেছিলেন এবং সেই সময় গৌরবঙ্গে ভক্তিরসের ঢেউয়ে ভেসে ছিলেন বহু মানুষ। শ্রীচৈতন্যদেব এই অঞ্চলের উপর দিয়ে বৃন্দাবন যাওয়ার সময় এলাকার অনেক মানুষ বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তার ফলস্বরূপ এই অঞ্চলে শাক্ত ও বৈষ্ণবধর্মের মিশ্রণ ঘটেছিল। তারই ফলে একই সঙ্গে কংসব্রত উৎসব ও পাটকালী পূজা বহুদিন ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। এই উপলক্ষে বসে মেলা। এই মেলা শুরু হয়েছিল প্রায় পাঁচশো বছর আগে। পুজো তিন চারদিনের হলেও এর প্রস্তুতি চলে অনেক আগের থেকে। এই উৎসব এই অঞ্চলের মানুষের কাছে ‘কাস-ব’ উৎসব বা ‘ব’ উৎসব নামে পরিচিত।
মাঘী পূর্ণিমার দিন এই কংস মূর্তির পূজা হয় এবং সেই সঙ্গে গ্ৰামপুজোও অনুষ্ঠিত হয়। পুজোর আয়োজনে কিছু বিশেষত্ব রয়েছে। সেটি হল আগুন বা ‘ধর্মের আগুন’ জ্বালানোর অনুষ্ঠান। ত্রয়োদশীর দিন সন্ধ্যাবেলায় ঢাকঢোল বাজিয়ে কাছের পুকুরে ডুব দিয়ে একটি কাঠের টুকরো তুলে আনা হয়। সেই কাঠের টুকরোটিতে প্রচুর তেল সিঁদুর মাখিয়ে সেটিকে মাথায় করে ভক্তরা পুরো গ্ৰাম প্রদক্ষিণ করেন। চতুর্দশীর দিন সন্ধ্যায় গ্ৰাম পুজো হয় এবং কংসের বেদীতে পুজো করে বাতাসার লুট দেওয়া হয়। বেদীতে পাঁঠা বলিও দেওয়া হয়।
আগুন পূজাই এই মেলায় প্রধান। তাই এই মেলাকে আগুনের মেলাও বলা হয়। পূর্ণিমার দিন আগুনকে ঘিরে চলে নানাবিধ আচার অনুষ্ঠান। এই উৎসবের জন্য গ্ৰামে একটি নির্দিষ্ট জায়গা আছে। একটা নতুন বড় হাঁড়িতে অনেকটা সর্ষের তেল দেওয়া হয়। পাশেই একটি নতুন মাটির সরায় কিছুটা বালি রাখা হয়। তারপর যোগ চিহ্নের আকারে মাটিতে একটি উনান খোঁড়া হয় এবং তাতে প্রচুর পরিমানে শুকনো কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়। তার মাঝখানে ঐ বালি ভর্তি সরাটি বসিয়ে তার উপর তেলভরা হাঁড়িটি বসানো হয়। দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন। এই আগুনে লম্বা একটি বাঁশের আগায় বাঁধা হাঁড়িতে করে মন্ত্রপূত গঙ্গাজল এবং দুধ ও জ্বলন্ত তেলে ঢালা হতে থাকে। একে ‘আহুতি’ বলা হয়।
প্রথম আহুতি দেওয়া হয় ‘ধর্মে’র নামে। জ্বলন্ত তেলে দুধ-জল পড়ায় আগুনের লেলিহান শিখা হঠাৎ অনেক উঁচুতে লাফিয়ে ওঠে। উপস্থিত মানুষরা ধর্মের জয়ধ্বনি দিয়ে ওঠেন। তারপর রাজার নামে, দেশের নামে, মেলার নামে, বৃষ্টির নামে- এরকম অনেক নামে আহুতি দেওয়া হয়। আহুতি অনুষ্ঠান শেষ হলে হাঁড়িতে যে পোড়া তেল থাকে তা অনেকেই সংগ্ৰহ করে নেয়। স্থানীয় অধিবাসীদের বিশ্বাস এই তেল মাখলে নানারকম রোগ ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
এই অগ্নি উৎসব শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনও বাড়িতে আগুন জ্বলে না। এই উৎসব এবং মেলা দেখতে দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে মানুষ উপস্থিত হন। সব মিলিয়ে প্রায় হাজার পঁচিশেক মানুষের সমাগম হয়।
নানারকম পশরা সাজিয়ে দোকান দেন ব্যবসায়ীরা। দেশের নানা প্রান্ত থেকে ব্যাপারীরা আসেন নানান সামগ্রী নিয়ে যেমন উত্তরপ্রদেশ থেকে কাপড়, পাঞ্জাব থেকে কম্বল, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে কাঠের আসবাবপত্র, তৈজসপত্র, মিষ্টি, মাটির এবং পিতলের বাসন। বসে নাগরদোলা, সার্কাস। মেলায় মানুষ আসেন অন্ততঃ তিন-চারদিনের ব্যবস্থা নিয়ে। মেলা কমিটির উৎসাহ উদ্যোগ চোখে পড়ার মতো থাকে। মাঘী পূর্ণিমায় কংসব্রত উৎসবের পরের দিন অর্থাৎ প্রতিপদের দিন বিকেলে হয় পাটকালী পুজো। এই অগ্নি উপাসনা এবং পাটকালী পুজো- দুই মিলিয়ে উৎসব চলে তিন-চারদিন ধরে। তবে মেলা মোটামুটি এক পক্ষকালব্যাপী চলে। মেলায় মানুষও আসেন অন্ততঃ তিন-চারদিনের ব্যবস্থা নিয়ে।
এবারের মেলা পর্ব শেষ করা যাক। আবার পরের সপ্তাহে যাব নতুন কোনও মেলায়। পাঠকবন্ধুরা, সবাইকে বাসন্তী শুভেচ্ছা জানাই।