বাংলার মেলা: তারকেশ্বরের শ্রাবণী মেলা

মেলা কথায় এবারের যাত্রা হুগলি জেলার তারকেশ্বরের শ্রাবণী মেলায়। শ্রাবণ মাস মানেই ঘোর বর্ষা ঋতু। আকাশ কালো করে যখন তখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি, ময়ূরদের পেখম মেলে নাচ, রাস্তাঘাটে থৈ থৈ জল, ধানক্ষেতে নতুন ধানের চারার জন্ম হওয়া এবং শ্রাবণ মাস মানেই পুণ্যার্থী হিন্দুদের কাছে শিবের আরাধনার মাস বা বাবা ভোলানাথের মাথায় জল ঢালার মাস।

 

প্রতি বছর শ্রাবণ মাসে লক্ষ লক্ষ ভক্ত মানুষ ভিড় জমান হুগলি জেলার তারকেশ্বরে বাবা তারকনাথের মন্দিরে–বাবার মাথায় জল ঢেলে ও পুজো দিয়ে পুণ্য অর্জনের আশায়। শ্রাবণ মাসের সোমবার করে শিবের পূজা করলে নাকি সব পাপ ধুয়ে মুছে যায়, মেলে মহাপুণ্য — এই বিশ্বাস থেকেই প্রতিবছর শ্রাবণ মাসে তারকেশ্বর মন্দিরে কাঁধে বাঁক নিয়ে তাতে কলসি ঝুলিয়ে জল বহন করে এনে তারকনাথ শিবের মাথায় জল ঢালতে আসেন হাজার হাজার মানুষ। আকাশ বাতাসে আলোড়ন তোলে "ভোলেবাবা পার করে গা" ধ্বনি। আর এই শ্রাবণ মাসেই তারকেশ্বরে শুরু হয় এক মাস ব্যাপী শ্রাবণী মেলা। গুরু পূর্ণিমায় শুরু হয়ে এই মেলা শেষ হয় ঝুলন পূর্ণিমায় বা রাখী পূর্ণিমার দিন।

 

এবার তারকেশ্বর মন্দিরের একটু বর্ণনা দেওয়া যাক। তারকেশ্বর বা তারকনাথ ধাম হিন্দুদের কাছে একটি প্রসিদ্ধ তীর্থস্থান। এই মন্দিরে অধিষ্ঠিত দেবতাকে "তারকনাথ" নামে আরাধনা করা হয়। ১৭২৯ সালে মল্ল রাজাদের দ্বারা নির্মিত এই মন্দিরটি একটি আটচালা মন্দির। সামনেই নাটমন্দির এবং পাশাপাশিই কালি এবং রাধাকৃষ্ণ মন্দিরও রয়েছে। তারকনাথ মন্দিরের উত্তর দিকে দুধপুকুর নামে একটি পুকুর আছে। ভক্তদের বিশ্বাস এই পুকুরে ডুব দিলে যাবতীয় মনোস্কামনা পূর্ণ হয় এবং সমস্ত রকম রোগভোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

Tarakeswar1

প্রচলিত কাহিনী অনুসারে তারকেশ্বর মন্দিরের ইতিহাস বহু পুরনো। এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা একজন অবাঙালি মানুষ। তিনি ছিলেন আদতে উত্তরপ্রদেশের অধিবাসী, নাম বিষ্ণুদাস। মানুষটি ছিলেন পরম শিবভক্ত। উত্তরপ্রদেশ থেকে এসে তিনি হুগলিতে বসবাস শুরু করেছিলেন। কিন্তু বাঙালি নন বলে স্থানীয় মানুষের হাতে তাকে বড় নির্যাতিত হতে হচ্ছিল।

 

এই বিষ্ণুদাসের ভাই একদিন এক গভীর জঙ্গলের মধ্যে দেখতে পেলেন মাটিতে পড়ে থাকা একটি কালো পাথরের উপর গরুরা গিয়ে দুধ দান করছে। তিনি এসে দাদা বিষ্ণুদাসকে এই কথা জানালেন। সেই দিনই বিষ্ণুদাস স্বপ্ন দেখলেন স্বয়ং মহেশ্বর তাঁকে আদেশ দিচ্ছেন জঙ্গলের সেই কালো পাথরটিকে শিব রূপে আরাধনা করার জন্য। এর পরই পাথরটিকে ঘিরে একটি ছোট মন্দির নির্মাণ করে পাথরটিকেই শিবরূপে পুজো শুরু করলেন বিষ্ণুদাস।

 

মহাদেবের তারকেশ্বর রূপের নামে ঐ শিবলিঙ্গের নাম রাখা হলো তারকনাথ। তারকেশ্বর শিবলিঙ্গ কেউ স্থাপন করে নি। তাছাড়া গঙ্গার পলল ভূমিতে ওরকম শিলা সাধারণতঃ পাওয়া যায় না। তাই তারকেশ্বরে মহাদেব স্বয়ং আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে মনে করা হয় এই শিবলিঙ্গকে বলা হয় "স্বয়ম্ভূলিঙ্গ"। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বহুবার সংস্কার করা হয়েছে এই মন্দিরটির। বর্তমান মন্দিরটি মল্লরাজাদেরই তৈরি।

 

তারকেশ্বর ঘিরে রয়েছে বহু কিংবদন্তী। বহু নারী সন্তানকামনায় এখানে এসে দন্ডী কেটে মন্দিরে গিয়ে বাবার পুজো দেন। কতো মানুষ তাদের মনোবাসনা জানান তারকনাথের কাছে।

Tarakeswar2

শ্রাবণী মেলায় ভক্তের ঢল নামে তারকেশ্বরে। সাজো সাজো রব পড়ে যায় গোটা তারকেশ্বর জুড়ে। আলোর মেলা দিয়ে সাজানো হয় সুন্দর করে। শ্যাওড়াফুলির গঙ্গা থেকে জল নিয়ে সেই জল প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে বয়ে এনে ভক্তরা তারকনাথ শিবের মাথায় ঢালেন আরাধ্য দেবতাকে তুষ্ট করার আশায়। পুরাণে বর্ণিত আছে সমুদ্র মন্থন হয়েছিল এই শ্রাবণেই। সেই মন্থণের ফলে উঠে আসা গরল পান করে নীলকন্ঠ হয়েছিলেন মহাদেব। সেই বিষের ভয়ঙ্কর জ্বালা নিবারণ করার জন্যই নাকি শিবলিঙ্গে অনর্গল জল ঢালবার রীতি প্রচলিত হয়েছিল। শ্রীশ্রী সারদা মা নাকি এই তারকেশ্বর মন্দিরে বেশ কয়েকবার পুজো দিতে এসেছিলেন।

 

গুরু পূর্ণিমা থেকে রাখী পূর্ণিমা পর্যন্ত চলা এই মেলায় ভালোই চলে বিক্রিবাটা কেনাকাটা। জল বহনের বাঁক থেকে শুরু করে ছোট বড় বিভিন্ন আকারের ঘন্টা, পাথর বা মাটির শিবলিঙ্গ, মহাদেবের মূর্তি এবং ছবি – সবকিছুই রমরমিয়ে বিক্রি হয়। পাশাপাশি রকমারী লোভনীয় খাবার দাবার, বিভিন্ন শৌখিন জিনিসপত্র, কাঠের ও মাটির বাসন, পুতুল, খেলনা – মেলার এসব আকর্ষণ তো আছেই। দেব দর্শন এবং মেলা দর্শন দুইই পাশাপাশি ভালোভাবেই চলতে থাকে। ব্যবসায়ীরাও খুশি মনে ঘরে ফেরেন, পুণ্যলোভী ভক্তের দলও পরের বছর আসার আকাঙ্ক্ষা ও মনে আনন্দ নিয়ে বাড়িমুখো হন। অপেক্ষা চলে পরের বছরের মেলার জন্য।

 

আজকের মেলা কথা তাহলে এখানে শেষ হোক? পরের সপ্তাহে আবার নতুন মেলা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...