"যাহাতে আমার নিজের কিছুমাত্র আনন্দ আছে, সেই আনন্দটুকু যখন দশ জনের মধ্যে বিতরণ করিতে চাহি, তখন উপলক্ষ্যের অভাব ঘটিবার কোনো কারণ দেখা যায় না। আমার আনন্দ সকলের আনন্দ হউক, আমার শুভে সকলের শুভ হউক- এই কল্যাণী ইচ্ছাই উৎসবের প্রাণ" – বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর
সকলে মিলে আনন্দ করা – আমাদের রাজ্যে, দেশে অথবা পৃথিবীর যে কোনো স্থানে যে কোনো মেলার মূল কথা কিন্তু এটাই। কোনো উৎসবে যদি উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সকল মানুষ অংশ নিতে পারে সেই মেলা বা উৎসবের সার্থকতা সেখানেই।
বাংলার মেলা-কথায় এবার আমরা চলে যাব বর্ধমান জেলার দুর্গাপুর। দুর্গাপুর শহরের থেকে তিন কিলোমিটার দূরে রয়েছে হেথা দোহা নামের একটা ছোট প্রাচীন গ্ৰাম। মূলত সমাজের আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষের বাস বেশি। দুর্গাপুরের মতো আধুনিক শিল্পনগরীর গায়ে লাগা দূরত্বে বসবাস করেও এদের সমাজ ও সংস্কৃতির খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। এই ছোট্ট শান্ত গ্ৰামটিতে মাঘ মাসের এক তারিখে বসে একটি একদিনের মেলা।
বাংলার বেশিরভাগ মেলাই কোনও না কোনও ধর্মীয় উৎসবকে উপলক্ষ করে বসে। সুদূর অতীতে এক এক অঞ্চলের দেবদেবীর পুজোকে কেন্দ্র করে বা তার মহিমা প্রচারের জন্য এক একটি মেলার সৃষ্টি। এই ছোট মেলাটিও তার ব্যতিক্রম নয়। হেথা দোহা গ্ৰামের দক্ষিণ পূর্ব দিকে মা হেথাই চণ্ডীর থান। উঁচু একটি বিস্তৃত ভূমিতে বড়ো বড়ো ঝোপ ঝাড় ও বনস্পতির ঘন ছায়ায় মা হেথাই চণ্ডী অবস্থান করছেন। এই অরণ্যকুঞ্জের মাঝখানে মাটির উপর রাখা কয়েকটি মূর্তি ভাঙা পাথরের খণ্ড।
এগুলি যে কোনো প্রাচীন দেবীমূর্তির ভাঙা টুকরো তা দেখেই বোঝা যায়। তেল সিঁদুর মাখা এই পাথরের খণ্ডগুলিই "মা হেথাই চণ্ডী" নামে পূজিতা হয়ে আসছেন বহু বছর ধরে। দেবীর কৃপার উপর স্থানীয় মানুষের অসীম আস্থা। দেবীর থানে কিছু রোগ নিরাময়ের জন্য ওষুধ পত্র খাইয়ে দেওয়া হয়। ওষুধের উপকরণ কী তা পুরোহিত ছাড়া কেউ জানে না। কিন্তু সরল আদিবাসী মানুষদের বিশ্বাস ঐ ওষুধে দেবীর কৃপার ছোঁয়া রয়েছে। সেই ওষুধ খাওয়ার পর সাত দিন আমিষ, দুধ, দুগ্ধজাত কোনো খাদ্য এবং মিষ্টি খাওয়া নিষেধ। যদি রোগমুক্তি ঘটে তাহলে মাঘ মাসের এক তারিখ মায়ের থানে এসে পুজো দিয়ে যেতে হয়। সেই উপলক্ষে বসে হেথাই চণ্ডীর মেলা।
হেথাই চণ্ডীর নামকরণকে জড়িয়ে একটি জনশ্রুতি প্রচলিত রয়েছে এই অঞ্চলে। হেথাই চণ্ডীর থানের কাছেই রয়েছে এক বিরাট হ্রদ। মা যেখানে স্থাপিত রয়েছেন সেই জমিটি উঁচু হলেও তার চারপাশের অঞ্চলগুলি নীচু জমি। বর্ষার সময় সরোবর উপচে জল ডাঙাজমিকে প্লাবিত করলেও বিস্তীর্ণ জলরাশির মধ্যে জেগে থাকে কেবল হেথাই চণ্ডীর থান। হেথাই চণ্ডীর থান দেখলে বোঝা যায় ঐ উঁচু জমিতে একসময় বিশাল মন্দির ছিল এবং সেখানে প্রতিষ্ঠিতা ছিলেন কালো পাথরে তৈরি হেথাই চণ্ডী। ভাঙা পাথরখণ্ডগুলো সেই দেবীমূর্তির টুকরো। এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন স্থানীয় জমিদার। তিনিই নিত্যপূজার ব্যবস্থা করেছিলেন।
এবার আসা যাক কাহিনীতে। প্রচলিত এই জনশ্রুতিটি একটা ব্যর্থ প্রেমের কাহিনী। একসময় নাকি স্থানীয় একজন জমিদারের ছেলে ভালোবেসেছিল নায়েবের কন্যার। কিন্তু তাদের এই ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দিতে চায় নি জমিদারবাবু। প্রবল বাধা দেন তিনি। কিন্তু যে নবীন তরুণ তরুণী পরস্পরকে এত ভালোবাসে তারা কেন মেনে নেবে বিচ্ছেদ? নিরুপায়, অসহায় দুই প্রেমিক প্রেমিকা ওই হ্রদে ডুবে আত্মহত্যা করে। খবর পেয়ে শোকে মূহ্যমান জমিদার (মতান্তরে রাজা) এবং তাঁর স্ত্রী ছুটে আসেন এবং স্থানীয় মানুষদের কাছে জানতে চান ঠিক কোথায় ডুবেছিল তাদের প্রাণাধিক প্রিয় পুত্রের। স্থানীয় লোকজন আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে বলেছিল "হেথা ডোবা"। উচ্চারিত হেথা ডোবা এই শব্দদুটি থেকে ঐ জলাশয়ের নাম হয়েছিল "হেথা ডোবা", গ্রামের নাম হেথা দোহা এবং দেবীর নাম হয় হেথাই চণ্ডী।
তবে হেথাই চণ্ডী এই অঞ্চলের জাগ্ৰত ও মান্য এক লৌকিক দেবী। চারপাশের গ্ৰামগুলি থেকে বহু মানুষ আসেন পুজো দিতে দেবীর কাছে। মাঘ মাসের প্রথম দিন মা হেথাই চণ্ডীর বিশেষ পুজো হয় এবং দেবীর থানের সামনের ধানক্ষেতে অস্থায়ী দোকান সাজিয়ে বসে মেলা। সেদিন সকাল থেকেই মেলা বসা শুরু হয়। আটটা নটার মধ্যেই মেলা জমজমাট। নানাবিধ খাদ্যসামগ্ৰী, গ্ৰামীণ সংসারের কাজে লাগার টুকিটাকি অজস্র জিনিস যেমন খুন্তি, হাতা, বেলন চাকি, বাচ্চাদের সস্তা খেলনা, পুতুল, পাখি, ঝুটো গয়না ইত্যাদি সামগ্ৰীতে সেজে ওঠে সারি সারি দোকান। আর পাওয়া যায় বিশেষ ধরনের পোড়ামাটির ঘোড়া। মায়ের ভক্তরা এই পোড়ামাটির ঘোড়া দেবীর থানে অর্পণ করে।
পাঁচ সাত হাজার মানুষ আসেন এই দিনে হেথাই চণ্ডীর পুজো দিতে এবং মেলা দেখতে। মায়ের সামনে আদিবাসীরা বলি দেন ছাগল, মুরগি, শুয়োর, পায়রা। দেবীর পূজা, অঞ্জলীর পাশাপাশি মেলায় মহানন্দে কেনাকাটা করেন মানুষ। গ্ৰামের বৌ মেয়েরা নানা রঙের জামাকাপড় পরে, নকল সোনার গহনা পরে, হাতভর্তি চুড়ি পরে হাসিমুখে দোকানে দোকানে ঘোরে। কচিকাঁচাদের হৈ চৈ, চেঁচামেচিতে জমে ওঠে মেলা।
বেলা চারটের পর থেকে মেলা ভাঙতে শুরু করে। সন্ধ্যা ছটার মধ্যে শেষ হয়ে যায় মেলা। শুরু হয় পরের বছরের অপেক্ষা।আজকের মেলা পর্ব এখানেই শেষ করছি। পরের পর্বে ডানা মেলব নতুন মেলায় আমার জিয়ো বাংলার পাঠক বন্ধুদের নিয়ে।