মেলা- বাংলা ব্যাঞ্জন বর্ণমালার থেকে মাত্র দুটি অক্ষর নিয়ে তৈরি হওয়া এই শব্দটি ছোট হলেও তার ব্যাপকতা বিশাল। মেলায় যেমন আগত দর্শনার্থীরা-ক্রেতা বিক্রেতারা পরস্পর ভাবের আদান-প্রদান করেন পাশাপাশি অপর দিকটি হলো পণ্যের বেচাকেনা। গ্ৰামের একঘেয়ে জীবনের মধ্যে বন্দী মানুষ মেলাকে কেন্দ্র করে প্রাণ পায়। একঘেয়েমি দূর হয়, দূরে যায় প্রতিদিনের যাপনের ক্লান্তি, সংকীর্ণতা। মনের প্রসারতা বাড়ে, মানুষের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়, সামাজিকতার বন্ধন দৃঢ়তর হয়। একটি মেলা আঞ্চলিক সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য বহন করে। তাই বহু যুগ থেকেই পুজো, যজ্ঞ, আবির্ভাব, তিরোভাব প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে কোনো মন্দির এলাকায়, নদীর ধারে বা সমুদ্রের তীরে মেলা বসে আসছে। এই ধারা আজও অব্যাহত।
"বাংলার মেলা কথা" নিয়ে মেলা কথা বলা হয়ে গিয়েছে এ পর্যন্ত। কিন্তু বাকিও আছে এখনোও বহু মেলা। আমাদের সোনার বাংলায় সোনালী সোনালী মেলা কম নাকি। "সোনালী" এই কারণেই বলা যে আমাদের রাজ্যের মেলাগুলো কখনই সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট নয়। যে ধর্মের উৎসব অনুষ্ঠান উপলক্ষেই মেলা বসুক না কেন, সব ধর্মের মানুষের সমাগম ঘটে সেখানে। সবাই আনন্দে মেতে ওঠে। অসাম্প্রদায়িকতার ঐতিহ্যের আলোয় সোনালী হয়ে ওঠে মেলা।
এবারের মেলা পর্বে আমরা রওনা দিলাম মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমা। আমাদের তো মনের ডানা মেলে উড়ে যাওয়া; তাই একটু পিছিয়ে পৌষ মাসের ১৯ তারিখ আমরা পৌঁছে যাব এই মহকুমার অন্তর্গত খড়গ্ৰাম থানার আতাই গ্ৰামে। এখানেই বসে নগর-দাদা পীরের মেলা। ১৯ আর ২০, পৌষের এই দু'দিন চলে মেলা।
দুশো বছরেরও বেশি আগে 'সাচাঁদ বাদশা' নামে এক ফকির আতাই গ্ৰামে এসেছিলেন। জনশ্রুতি, তিনি নানারকম অলৌকিক কার্যকলাপ দেখাতে পারতেন। তা দেখে মানুষ তাঁকে দাদা পীর বলে ডাকত। এই গ্ৰামে একটি দিঘি ছিল যার নাম বড়দিঘি, সেই দিঘির দক্ষিণ পাড়ে বাস করতেন। ৫৯৬ সালের ২০পৌষ তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। সেই বড়দিঘির দক্ষিণ পাড়েই দাদা পিরের মাজার রয়েছে। এই মাজারকে কেন্দ্র করেই মেলা বসে। কথিত রয়েছে দাদা পিরের প্রিয় শিষ্য দাউদ আলি প্রায় দেড়শো বছর আগে এই মেলার প্রচলন করেন। এখানে দাদা পিরের ভক্তরা তাদের মনোস্কামনা জানিয়ে মানসিক করেন। মানত পূরণ হলে ভক্তরা এই মাজারে হাঁস, ছাগল, ভেড়া বলি দেন। রান্না করা মাংস, ভাত "সিন্নি" দেওয়া হয়। মিষ্টির দোকান, তেলেভাজার দোকান, খেলনা পুতুলের দোকান, নাগরদোলা, লোহার জিনিস থেকে জুতোর দোকান সবই বসে এই মেলায়। ফকির বাউলরা এসে দেহতত্ত্বের গান গেয়ে বেড়ান। পুতুলনাচের আসরও থাকে। খুশির উপকরণ অঢেল। মাটির ঘোড়া এবং কাঁকনাড়ু বিক্রির ধুম পড়ে যায়। এই মেলার নিজস্ব খাবার জিনিস হলো কাঁকনাড়ু। দাদা পীরের মেলা ছাড়া এই খাদ্যবস্তুটি কোথাও পাওয়া যায় না। দাদা পীরের মেলা মানেই নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মেলায় পরিবেশিত হয় আলকাপ, যাত্রা, নাটক। এই মেলায় পুরুষদের থেকে মহিলাদের ভিড় বেশি হয়। হিন্দু মুসলমান সব ধর্মের মানুষের সমাগম হয় এই মেলায়। বিপুল মানুষের সমাগমে এই মেলা অসাম্প্রদায়িকতার উজ্জ্বল ঐতিহ্য বয়ে নিয়ে চলেছে।
এবারে মেলায় বেড়ানো শেষ করা যাক। পরের পর্বে নতুন মেলায় যাওয়া যাবে।
ছবিঃ প্রতীকী