দেখতে দেখতে শেষ হয়ে এল একটা গোটা বছর। এই শতাব্দীও শৈশব, কৈশোর কাটিয়ে এখন পূর্ণ যৌবনা। একুশ পেরিয়ে ক'দিন পরই বাইশে পা দেবে সে। তার বাইশে পা দেওয়ার আগের দিন কটায় চলুন আমরা ঘুরে আসি একটা নতুন মেলায়।
ভারতে বা এই আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে যে কোনো মেলাই বসে কোনও না কোনও ধর্মীয় উপলক্ষ বা ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে। এবারের মেলা পর্বে আমরা যে মেলায় বেড়াতে যাব সেটা ঠিক ধর্মীয় বলা যায় না। আসলে এই মেলাটি বসে বড়দিন উপলক্ষে। যদিও বড়দিন বা যীশুখ্রীষ্টের জন্মদিন সারা পৃথিবীতে খ্রীষ্টধর্মাবলম্বীদের শ্রেষ্ঠ উৎসব কিন্তু বাঙালির কাছে বড়দিন ঠিক বিশেষ কোনো ধর্মের উৎসব নয়। দুর্গাপূজাও যেমন জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালির প্রাণের উৎসব, বড়দিনও হলো সমস্ত বাঙালির কাছে শীতের আমেজ উপভোগ করতে করতে সোয়েটার, শাল জড়িয়ে বেড়ানোর আর কেক খাওয়ার এবং খাওয়ানোর উৎসব।
এই বড়দিন উপলক্ষে বাংলার নদীয়া জেলার চাপড়ায় বসে সাতদিনের একটি জমজমাট এবং জমকালো মেলা। চলুন, নরম শীতের নরম রোদ গায়ে মেখে আমরা পা বাড়াই চাপড়া বড়দিনের মেলায়।
নদীয়া জেলার ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অতি সমৃদ্ধ। মহাপ্রভুর আপন এই নদিয়া জেলায় বারো মাসে তেরো পার্বণ। এই নদিয়ার চাপড়ার শতবর্য অতিক্রান্ত বড়দিনের খ্রীষ্টীয় মেলাটি কিন্তু বাঙালিয়ানায় মাখামাখি। এই জেলায় আরো কয়েকটি বড়দিনের মেলা বসলেও চাপড়ার মেলার নাম ও খ্যাতি সবথেকে বেশি। এক সময় খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বর্ষ শেষের এই মেলা মানুষের বিশেষ করে বলতে গেলে বাঙালির এক মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। চাপড়াতে একটি প্রোটেস্টান্ট গির্জা রয়েছে। এর কাছেই কিং এডওয়ার্ড স্কুলের মাঠে বসে এই বড়দিনের মেলা। এখানকার মানুষ সারা বছর ধরে প্রতীক্ষা করেন এই মেলার জন্য।
এবার একটু এই মেলার ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক। পুরনো তথ্য থেকে জানা যায়, মেলাটি সম্ভবতঃ শুরু হয়েছিল অবিভক্ত বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশের) রতনপুরে। পরবর্তী কালে চাপড়ায় চলে আসে সেই মেলা। চাপড়ার এই মেলা ১০৮ বছরের প্রাচীন।
চাপড়া বসবাসকারী খ্রীষ্টান সমাজের বেশ কিছু নিজস্বতার সঙ্গে আছে যাতে আবহমানকালের বাঙালিয়ানা মিশে গিয়েছে। চব্বিশে ডিসেম্বর রাত বারোটা বাজলে যে ক্রিসমাস ক্যারোল গাওয়া হয় সেই প্রার্থনা সঙ্গীতের পাশাপাশি বড়দিনের প্রার্থনায় গাওয়া হয় খ্রিস্টীয় কীর্তন। এই উপলক্ষে প্রতি বছর কবিগান বা পালাগান রচয়িতারা রচনা করেন নতুন নতুন কীর্তন।
খ্রীষ্টীয় কীর্তন! সে আবার কেমন? এটাই এখানকার বিশেষত্ব এবং ঐতিহ্য। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মভূমিতে কীর্তন হবে না তা ও কি হয়? প্রাচীন গ্ৰাম বাংলার ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণাকারী সুধীর চক্রবর্তীর রচনা থেকে জানা যায় অতীতে একসময় এখানকার চার্চের পাদ্রি ছিলেন মতিলাল মল্লিক। তিনি নবদ্বীপে গিয়ে কীর্তন শিখে ফিরে এসে এই চাপড়ায় খ্রিস্টীয় কীর্তনের প্রবর্তন করেন। সেই কীর্তনধারা আজও চলছে। বড়দিন কিংবা ইস্টারের সময় এখনোও যীশুভক্তরা হুবহু "ভজ গৌরাঙ্গ কহো গৌরাঙ্গ লহ গৌরাঙ্গের নাম রে" - এই কীর্তনগানের সুরে যীশুখ্রীষ্টের মানবপ্রেমের গান গেয়ে পথ পরিক্রমা করেন।
এবার মেলার আনন্দে সামিল হওয়া যাক। বড়দিন এবং ইংরেজি নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে এই মেলা চলে ২৫ ডিসেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই মেলা উপলক্ষে প্রকাশিত হয় একটি পত্রিকা। ভরা শীতের মজা পুরোদমে নেওয়ার জন্য আয়োজিত হয় নানা ধরনের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও টুর্নামেন্ট। এখানে একটা দারুন খেলার আয়োজন হয় তা হলো লাঠি খেলা। চলে নানাবিধ হস্তশিল্পের প্রদর্শনী ও সেসব অপূর্ব জিনিসপত্র বিক্রি। সেই বিক্রয় তালিকায় কাঁথা, পাটের রকমারি জিনিস থেকে শুরু করে থাকে বাড়িতে তৈরি রকমারি পিঠে পুলিও।
সম্পূর্ণ বাংলার সংস্কৃতি বহন করে চলেছে এই মেলা যেখানে বিভিন্ন ধরণের, বিভিন্ন স্বাদের কেক, পেস্ট্রির সঙ্গেই দেদার বিক্রি হয় পিঠে, পুলি ও নানাবিধ মিঠাই।। একটি পশুপাখির প্রদর্শনীরও আয়োজন করা হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকে যাত্রা, পালাগান, রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা এবং আবৃত্তিও।
মেলায় প্রতিদিন অন্তত কুড়ি হাজার মানুষের আগমন হয়েই থাকে। আর স্পোর্টস টুর্নামেন্টের দিনগুলোতে দর্শকসংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। মেলা দেখতে আসা মানুষের রসনার তৃপ্তির জন্য থাকে অসংখ্য খাবারের স্টলও। সেখানে রমরমিয়ে বিক্রি হয় চপ, কাটলেট, জিলিপি, মালপুয়া, পিঠে, পুলি, কেক, পাই আরও কত লোভনীয় খাবার। আর ঘরকন্নার তৈজসপত্র, মেয়েদের সাজগোজের সামগ্রী ছোটদের খেলনা পুতুল এসব তো আছেই। ক্রেতা বিক্রেতা সবাই খুশি।
পাঠকবন্ধুরা, কেমন লাগলো এই বড়দিনের মেলায় বেড়িয়ে? পরের সপ্তাহে আবার নতুন কোনও মেলায় বেড়াতে যাব আমরা। সবাইকে জানাই বড়দিনের শুভেচ্ছা।